গত বছর এমন দিনে অনেক হিসাব–নিকাশ করে কর্মসূচি পালন করতে হয়েছে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীকে। পথে নামতে গেলেই পুলিশের বাধা ও প্রতিরোধের মুখে পড়তে হয়েছে দলগুলোকে। তবে এখন পরিস্থিতি পুরোটাই পাল্টে গেছে। এখন মৌলভীবাজারে দল দুটি ফুরফুরে মেজাজে তাদের দলীয় কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
বিএনপি উপজেলা, পৌরসভাসহ সব স্তরের কমিটি গঠনে মনোযোগ দিয়েছে। গণতান্ত্রিক চর্চা বাড়াতে তৃণমূলের সদস্যদের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হচ্ছেন ওয়ার্ড পর্যায়ের কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। অপর দিকে জামায়াতে ইসলামী দলীয় বিভিন্ন কর্মসূচির পাশাপাশি জেলার চারটি সংসদীয় আসনে তাদের সম্ভাব্য প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে। উপজেলা, ইউনিয়ন ও পৌরসভার সম্ভাব্য প্রার্থীদের প্যানেল তৈরি করে নির্বাচনের প্রস্তুতি অনেকখানি এগিয়ে রেখেছে দলটি।
অন্যদিকে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) মিছিল ও মিটিংয়ের মাধ্যমে সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) নেতৃত্বাধীন বাম গণতান্ত্রিক জোট সাংগঠনিক কার্যক্রমসহ বিভিন্ন দাবিতে বিক্ষোভ ও সভা–সমাবেশ করছে।
আওয়ামী লীগের কোনো পর্যায়ের নেতা–কর্মীকে এখন মাঠে দেখা যাচ্ছে না। দলের নেতৃস্থানীয় নেতা–কর্মীর উপস্থিতিকে কেন্দ্র করে যেসব স্থান সরগরম থাকত, সেখানে এখন সেই ভিড় আর নেই। জেলা ও উপজেলার শীর্ষ পর্যায়ের প্রায় সব নেতা–কর্মী আত্মগোপনে আছেন।
জেলা বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ৫ আগস্টের আগে পুলিশি বাধার মুখে দলের বিভিন্ন কার্যক্রম ও কর্মসূচি বাস্তবায়ন কঠিন ছিল। অনেক হিসাব–নিকাশ করে রাস্তায় নামতে হয়েছে। রাস্তায় নামলেই পুলিশের বাধার মুখে পড়তে হয়েছে নেতা–কর্মীদের। নেতা–কর্মীদের মধ্যে হামলা ও মামলার ভয়ভীতি ছিল। গত বছরের ৫ আগস্টের পর সেই পরিস্থিতি আর নেই। সব বাধা সরে গেছে। ভয়ভীতিমুক্ত পরিবেশে দলের নেতা–কর্মীরা মাঠে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। ফুরফুরে মেজাজে দলের কার্যক্রম ও কর্মসূচি পরিচালিত হচ্ছে।
বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর স্বাক্ষরে গত বছরের নভেম্বরে জেলা কমিটি ভেঙে ৩২ সদস্যবিশিষ্ট জেলা আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। আহ্বায়ক নির্বাচিত করা হয় জেলা বিএনপির সাবেক জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ও মৌলভীবাজার পৌরসভার সাবেক মেয়র ফয়জুল করিমকে (ময়ূন)। এই কমিটিতে জেলা কমিটির সাবেক সভাপতি এম নাসের রহমান ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমানসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা–কর্মীকে সদস্য করা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে আহ্বায়ক কমিটির সদস্যসচিব করা হয়েছে আবদুর রহিমকে। এই আহ্বায়ক কমিটি জেলা সম্মেলনের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করার কথা আছে।
আগে কর্মসূচি পালন করতে হিসাব–নিকাশ লাগত, এখন আর হিসাব–নিকাশ নেই। পুলিশের বাধা–বিপত্তি নেই। নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারছি।
এই কমিটি গঠনের পর তৃণমূল পর্যায়ে দল গোছানোয় মনোযোগ দিয়েছে মৌলভীবাজার জেলা বিএনপি। জেলা কমিটির উদ্যোগে কর্মী সমাবেশসহ বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। এতে দলের মধ্যে প্রাণ সঞ্চার হয়েছে। জেলার সাতটি উপজেলা ও পাঁচটি পৌরসভায় আহ্বায়ক কমিটি করা হয়েছে। সব কটি উপজেলা ও পৌরসভায় সম্মেলন করার প্রস্তুতি চলছে। চলতি মাসেই দু–একটি উপজেলার সম্মেলন হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তবে ইউনিয়ন ও পৌরসভার ওয়ার্ড পর্যায়ে সম্মেলন চলছে। ওয়ার্ড পর্যায়ের সম্মেলনে গণতান্ত্রিক চর্চায় নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হচ্ছে দল।
আগে যেখানে ঊর্ধ্বতন কমিটি ঘরে বসে বিভিন্ন ওয়ার্ড কমিটি গঠন করে দিয়েছে, এবার সেই পটভূমি আর নেই। ওয়ার্ড কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হচ্ছেন সদস্যদের সরাসরি ভোটে। নেতৃত্বের মধ্যে প্রতিযোগিতা হচ্ছে, আলাপ হচ্ছে, তর্ক হচ্ছে। কে দীর্ঘদিন ধরে বিএনপির কর্মী, কে আওয়ামী লীগের দোসর ছিলেন, কে আওয়ামী লীগের সময় আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। ইউনিয়ন, ওয়ার্ড ও গ্রাম পর্যায়ে এসব নিয়ে দলের নেতা–কর্মীর মধ্যে আলোচনা হচ্ছে।
জেলা কমিটির এখনো কার্যালয় নেই। জেলার নেতাদের বাসাবাড়ি ও ব্যক্তিগত কার্যালয়ে নেতা–কর্মীরা বসছেন। তবে মৌলভীবাজার শহরের সৈয়দ মুজতবা আলী সড়কে দলের পুরোনো কার্যালয়কে নতুন করে চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অপর দিকে সংসদ নির্বাচনসহ স্থানীয় নির্বাচনে যাঁরা প্রার্থী হতে পারেন, ব্যক্তিগত উদ্যোগে বিভিন্ন সামাজিক কাজে তাঁরা তৎপর আছেন। সংসদ সদস্যসহ বিভিন্ন পর্যায়ে কারা প্রার্থী হতে পারেন, তা নিয়ে দলের নেতা–কর্মীদের মধ্যে আলাপ–আলোচনা হলেও দলীয় পর্যায়ে এ নিয়ে কোনো প্রকাশ্য তৎপরতা এখনো চোখে পড়ছে না।
বিএনপি জেলা কমিটির আহ্বায়ক ফয়জুল করিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগে কর্মসূচি পালন করতে হিসাব–নিকাশ লাগত, এখন আর হিসাব–নিকাশ নেই। পুলিশের বাধা–বিপত্তি নেই। নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারছি। বিএনপি এখন ফুরফুরে মেজাজে কাজ করছে। উপজেলা ও পৌরসভা সম্মেলন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, করা হবে। তবে ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে সম্মেলন চলছে।’ এখনো নির্বাচনী তৎপরতার নির্দেশনা নেই জানিয়ে তিনি বলেন, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে দলকে গণতান্ত্রিকভাবে তৈরি করতে কাজ চলছে।
জামায়াতে ইসলামী সূত্রে জানা গেছে, জামায়াতে ইসলামী এখন প্রকাশ্যে মাঠে কাজ করছে। প্রকাশ্যে দলের তৎপরতা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। কর্মী সমাবেশ, গণসংযোগসহ বিভিন্ন কার্যক্রম করছে দলটি। আগে যে কর্মসূচি প্রশাসনের বাধার কারণে ঘরোয়াভাবে করতে হয়েছে, এখন তা প্রকাশ্যে করতে পারছে দলটি। গত ডিসেম্বরে মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চবিদ্যালয় মাঠে কেন্দ্রীয় আমির শফিকুর রহমানের উপস্থিতিতে বিশাল কর্মিসভা করা হয়েছে। এখানে দলের কার্যালয় নেই। তবে স্থায়ী কার্যালয় করার প্রস্তুতি আছে দলটির। মৌলভীবাজার জেলার চারটি সংসদীয় আসনে দলের প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেছে জামায়াতে ইসলামী।
আগে প্রোগ্রাম ইনডোরে করতাম। এখন প্রকাশ্যে মুক্ত পরিবেশে স্বাভাবিক কার্যক্রম করতে পারছি। মানুষের কাছে যেতে পারছি।
উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সম্ভাব্য প্রার্থীর প্যানেল তৈরি করেছে জামায়াত। নির্বাচনে অংশ নিতে দলটি অনেকটাই কাজ গুছিয়ে রেখেছে।
জামায়াতে ইসলামী মৌলভীবাজার জেলার সেক্রেটারি মো. ইয়ামির আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগে প্রোগ্রাম ইনডোরে করতাম। এখন প্রকাশ্যে মুক্ত পরিবেশে স্বাভাবিক কার্যক্রম করতে পারছি। মানুষের কাছে যেতে পারছি। আমাদের মতামত তুলে ধরতে পারছি। প্রশাসন থেকেও এখন দাওয়াত মিলছে। বিভিন্ন কমিটিতে আমাদের রাখা হচ্ছে।’
এনসিপি এখনো মৌলভীবাজার জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কমিটি গঠন করেনি। তবে মিছিল–মিটিংসহ দলের সাংগঠনিক তৎপরতা আছে। এনসিপি সিলেট অঞ্চলের তত্ত্বাবধায়ক প্রীতম দাশ বলেন, ‘আমাদের জেলা ও উপজেলা কমিটি এখনো হয়নি। তবে সাংগঠনিক কার্যক্রম চলছে। মিটিং ও মিছিল হচ্ছে।’