৩১৮ সোনার বারের মামলা: ‘কেস ডকেট’ গায়েব, ২৮ বছরে একজনেরও সাক্ষ্য হয়নি
১৯৯৬ সালের ১৪ অক্টোবর চট্টগ্রাম বন্দরে এমভি কিউসি টিল জাহাজ থেকে ৩১৮টি সোনার বার উদ্ধার করা হয়।
মামলাটি ২৮ বছর আগে সিঙ্গাপুর থেকে আনা চট্টগ্রাম বন্দরে একটি জাহাজ থেকে ৩১৮ সোনার বার উদ্ধারের ঘটনার। সেই মামলাটির কেস ডকেট (সিডি) পাওয়া যাচ্ছে না। প্রথম অতিরিক্ত চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালতে বর্তমানে মামলাটি বিচারাধীন। বিচারক সিডির সন্ধান চেয়ে চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালতের তৎকালীন সরকারি কৌঁসুলিকে (পিপি) চিঠি দেন। চিঠিতে পিপি উল্লেখ করেন, সিডিটি তাঁর কাছে নেই। এতে থেমে আছে সাক্ষ্য গ্রহণ। অথচ হাইকোর্ট ৯ বছর আগে ছয় মাসের মধ্যে মামলাটি নিষ্পত্তির আদেশ দিয়েছিলেন।
এর মধ্যে গত রোববার মহানগর পিপির কার্যালয়ের সামনের বারান্দা থেকে ১ হাজার ৯১১টি মামলার সিডি গায়েব হয়ে যায়। এসব সিডির হদিস এখনো মেলেনি।
সিডি না থাকায় আসামি খালাস পেলে চোরাচালানিরা উৎসাহিত হবে।নাজিম উদ্দিন চৌধুরী, সভাপতি, চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতি
আদালত সূত্র জানায়, ১৯৯৬ সালের ১৪ অক্টোবর চট্টগ্রাম বন্দরের ৩ নম্বর ঘাটে এমভি কিউসি টিল জাহাজ থেকে মালামাল খালাসকালে ৩১৮টি সোনার বার উদ্ধারের ঘটনায় চট্টগ্রাম কাস্টমসের তৎকালীন সুপারিনটেনডেন্ট কাজী মো. নওশেরুল্লাহ বাদী হয়ে চোরাচালানের অভিযোগে বিশেষ ক্ষমতা আইনে নগরের বন্দর থানায় মামলা করেন। এতে আসামি করা হয় ১০ জনকে। তাঁরা হলেন, এমভি কিউসি টিল জাহাজের ক্রু (নাবিক) আবুল বাসার ও দেলোয়ার হোসেন, ওয়াচম্যান মীর হোসেন, কিউসি শিপিং অফিসের কর্মকর্তা স্বপন ঘোষ, এস এম নাছির উদ্দিন, মঈনুল আজম, বোরহান উদ্দিন, বন্দরের লস্কর জসিম উদ্দিন, তাঁর সহযোগী দিদারুল আলম ও দেলোয়ার হোসেন। তদন্ত শেষে পরের বছরের ৭ এপ্রিল ওই ১০ জনের বিরুদ্ধে আদালতে দেওয়া অভিযোগপত্রে বলা হয়, সিঙ্গাপুরের এয়াকুব অ্যান্ড সন্স থেকে সোনার বারগুলো বাহক হিসেবে কিউসি টিল জাহাজে করে আনা হয়।
২০০০ সালের ১৯ এপ্রিল আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু করেন আদালত। এই আদেশের বিরুদ্ধে আসামিদের পক্ষ থেকে আবুল বাসার ওই বছরের আগস্টে হাইকোর্টে আপিল করেন। ২০১৪ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট আসামিদের করা আপিল নাকচ করে দেন।
হাইকোর্টের সেই আদেশটি ছয় বছর পর ২০২১ সালের ২৫ আগস্ট তারিখে প্রথম অতিরিক্ত চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালতে নথিতে যুক্ত হয়। স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার হওয়ায় মামলার সাক্ষ্য শুরু করার কথা থাকলেও সাক্ষীদের হাজির করতে কোনো সমন ও আসামিদের বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি করা হয়নি। উল্টো প্রতিটি ধার্য দিনে নথিতে লেখা হয়েছে আসামিরা জামিনে রয়েছেন। সাক্ষীদের সমন ইস্যু করা হয়েছে। এভাবে ২০২১ সালের আগস্ট থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত চলে আসছে।
উল্লিখিত বিষয়টি গত বছরের শুরুতে বিচারকের নজরে আসে। তিনি বর্তমানে দায়িত্বে থাকা বেঞ্চ সহকারী নাছির উদ্দিন ভুঁইয়ার কাছে কারণ ব্যাখ্যা চান। এতে বলা হয়, আসামিপক্ষে কোনো পদক্ষেপ না নেওয়া সত্ত্বেও আসামিদের জামিন বাতিল না করে হাজির দেখানো হচ্ছে নথিতে। এ ছাড়া সাক্ষীদের হাজির করতে কোনো সমন জারির আদেশ লিপিবদ্ধ করেননি।
নাছির উদ্দিন ভুঁইয়া জবাবে আদালতকে জানান, ‘আমার পূর্বেকার বেঞ্চ সহকারী শহিদুল ইসলাম আসামিদের কোনো পদক্ষেপ না থাকলেও তাঁদের জামিন বাতিল কিংবা সাক্ষীদের সমন ইস্যুর আদেশ লিপিবদ্ধ করেননি।’ বিচারক শহীদুল ইসলামের কাছেও কারণ ব্যাখ্যা চান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিষয়টি খেয়াল করিনি। আসামিদের কাছ থেকে কোনো সুবিধা নিইনি।’ তবে জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা বলছেন, আসামিদের সুবিধা দিতে এই কাজ করা হয়েছে।
সিডি গায়েব
আইনজীবীরা জানান, আসামিদের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণে সিডি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সিডিটি না পাওয়ায় বিচারক গত বছরের ১৬ মে তৎকালীন মহানগর পিপি মো. আবদুর রশিদকে চিঠি দেন। এতে বলা হয়, ‘তদন্তকারী কর্মকর্তাকে হাজির করেও পিপি মামলার সিডি উপস্থাপন না করায় সাক্ষ্য গ্রহণ সম্ভব হয়নি।’ ২৩ মে পিপি চিঠি দিয়ে জানান, সিডিটি তাঁর কাছে নাই।
এই মামলায় সাক্ষী রয়েছেন মোট আটজন। তাঁরা সবাই চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টম হাউসের সাবেক কর্মকর্তা-কর্মচারী। পুলিশ জানায়, সাক্ষীদের একজন চট্টগ্রাম বন্দরের নিরাপত্তারক্ষী অজিত কুমার রায় গত বছরের ২৯ জানুয়ারি মারা যান।
সমন পাওয়ার পর সাক্ষ্য দিতে বেশ কয়েকবার হাজির হন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এম এ নেওয়াজী। তিনি গত সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, অনেক আগের ঘটনা। সিডি না থাকায় সাক্ষ্য না দিয়ে চলে যেতে হয়েছে।
চোরাচালান মামলার সিডি গায়েবের ঘটনায় কে বা কারা জড়িত তাঁদের বের করা উচিত বলে মন্তব্য করেন চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি নাজিম উদ্দিন চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সিডি না থাকায় আসামি খালাস পেলে চোরাচালানিরা উৎসাহিত হবে।