চট্টগ্রামে ডেঙ্গু বাড়ছে, মশা নিধনে পুরোনো তথ্যেই ভরসা
জুন-জুলাই থেকে চট্টগ্রামে ডেঙ্গু বাড়তে শুরু করেছে। ডেঙ্গু মোকাবিলায় সিটি করপোরেশন ও সিভিল সার্জন কার্যালয় বিভিন্ন সচেতনতামূলক পদক্ষেপ নিয়েছে। এ ছাড়া করপোরেশন মশা নিয়ন্ত্রণে ওষুধ ছিটাচ্ছে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে দেড় বছর আগে জরিপের মাধ্যমে হটস্পট চিহ্নিত করেছিল সিটি করপোরেশন। নতুন কোনো হালনাগাদ তথ্য নেই সংস্থাটির হাতে। ওষুধ ছিটানো হচ্ছে দেড় বছর আগের ওই জরিপ অনুযায়ী।
বর্ষা শুরুর সঙ্গে সঙ্গে চট্টগ্রামে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। জুন-জুলাইতেই শনাক্ত হয়েছে দুই শতাধিক রোগী। পরিস্থিতি মোকাবিলায় ডেঙ্গুজ্বরের বাহক এডিস মশা নিধনে করপোরেশন তিন থেকে পাঁচ মাসের একটি ক্রাশ কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। তবে এই কর্মসূচি চলছে চট্টগ্রাম নগরে মশার প্রজননের ওপর পুরোনো জরিপ ধরে। অর্থাৎ কোন এলাকায় মশার প্রজনন বেশি, তা নিয়ে নতুন করে কোনো জরিপ নেই।
প্রতিবছর জুন থেকে অক্টোবর–নভেম্বর পর্যন্ত সময়কে ডেঙ্গুর প্রধান মৌসুম ধরে স্বাস্থ্য বিভাগ। সারা বছর ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গেলেও এই সময়টাতে রোগী বেড়ে যায়। বৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে জমে থাকা পানিতে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার প্রজনন হয়। সে হিসেবে বর্ষার শুরু থেকে এবারও ডেঙ্গু রোগী ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করেছে। একই মশার কামড়ে চিকুনগুনিয়া রোগও হয়। এবার চিকুনগুনিয়াও ভালোভাবে মাথাচাড়া দিয়েছে।
২০২৩-২৪ সালে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর), সিটি করপোরেশন ও সিভিল সার্জন কার্যালয়ের সমন্বয়ে একটি জরিপকাজ চলে। এতে চট্টগ্রামে এডিস মশার প্রজননক্ষেত্র হিসেবে পাঁচটি এলাকাকে হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এগুলো হলো কোতোয়ালি, বাকলিয়া, বায়েজিদ, চকবাজার ও বন্দর এলাকা। ওই জরিপ ধরেই বর্তমানে মশকনিধন কার্যক্রম চলছে। নতুন কোনো গবেষণা এখন আর হয়নি।
চলতি মাসের প্রথম পাঁচ দিনে মোট ডেঙ্গু রোগী মিলেছে ৫০ জন। জুন মাসে মোট ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যায় ১৭৬ জন। চলতি বছর চট্টগ্রামের মোট রোগী ৪৯৫ জন ডেঙ্গু রোগীর প্রায় অর্ধেকই জুন থেকে এ পর্যন্ত পাওয়া গেছে। চলতি বছর মারা গেছে দুজন। ডেঙ্গু বাড়ার আরও বড় প্রমাণ পাওয়া যায় হাসপাতালের ভর্তি তালিকা থেকে। গতকাল শনিবার মোট ৪৩ জন রোগী ভর্তি ছিল বিভিন্ন হাসপাতালে। অথচ ১৪ জুন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি ছিল মাত্র ২২ জন।
সিভিল সার্জন জাহাঙ্গীর আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বৃষ্টি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ডেঙ্গু রোগী বাড়তে শুরু করেছে। নগর এবং উপজেলাগুলোতেও ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যাচ্ছে। সামনের কয়েক মাস এই রোগ নিয়ে সতর্ক থাকতে হবে। আমরা ডেঙ্গু মোকাবিলায় সচেতনতা তৈরিসহ নানাভাবে প্রস্তুতি নিয়েছি।’
পুরোনো জরিপে ওষুধ ছিটানো
ডেঙ্গু মোকাবিলায় সিটি করপোরেশন ইতিমধ্যে কার্যক্রম শুরু করেছে। ২৮ জুন থেকে শুরু হওয়া ক্রাশ কর্মসূচি অনুযায়ী করপোরেশন প্রতিদিন প্রজননপ্রবণ তিনটি স্থানে মশকনিধনে প্রায় ৭০ জন কর্মী সচেষ্ট থাকেন। এ ছাড়া সাধারণভাবে প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকায় সকালে লার্ভিসাইট ওষুধ ছিটাচ্ছে এবং বিকেলে ফগিং করা হয় বলে জানান সিটি করপোরেশনের ম্যালেরিয়া ও মশক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা মো. শরফুল ইসলাম।
২০২৩-২৪ সালে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর), সিটি করপোরেশন ও সিভিল সার্জন কার্যালয়ের সমন্বয়ে একটি জরিপ কাজ চলে। এতে চট্টগ্রামে এডিস মশার প্রজননক্ষেত্র হিসেবে পাঁচটি এলাকাকে হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এগুলো হলো কোতোয়ালি, বাকলিয়া, বায়েজিদ, চকবাজার ও বন্দর এলাকা। ওই জরিপ ধরেই বর্তমানে মশকনিধন কার্যক্রম চলছে। নতুন কোনো গবেষণা এখন আর হয়নি।
মশক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা শরফুল ইসলাম বলেন, সারা বছর স্প্রে ও ফগিং কার্যক্রম চলে। ক্রাশ কর্মসূচি হটস্পট ধরে করা হচ্ছে। আগের জরিপ অনুযায়ী এটা করা হচ্ছে। সেই হটস্পটগুলো এখনো বিদ্যমান রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন। নতুন জরিপ কাজ না হওয়া পর্যন্ত এভাবেই নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি চলবে।
সিটি করপোরেশন মশা নিধনে তিন মাস আগে বাকলিয়া এলাকায় একটি পরীক্ষামূলক প্রকল্প হাতে নিয়েছিল। ওই প্রকল্পে যুক্তরাষ্ট্রের একটি গবেষণাভিত্তিক নতুন মশা নিধন সমাধান বায়োলজিক্যাল লার্ভিসাইড ‘বিটিআই’ পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করছে। এতে ফল ভালো পেয়েছেন বলে দাবি করেছেন মেয়র শাহাদাত হোসেন।
তবে গত ফেব্রুয়ারিতে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) একটি দল জরিপ করে গেছে। সেই জরিপটির ফলাফল এখনো করপোরেশন হাতে পায়নি। কিন্তু ফেব্রুয়ারিতে জরিপকাজ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। কারণ, ফেব্রুয়ারি মাসে এডিস মশার বিস্তার ততটা থাকে না, যতটা বর্ষার এই সময়টাতে বিদ্যমান। ফেব্রুয়ারি মাসে চট্টগ্রামে মোট ডেঙ্গু রোগী ছিল ২৮ জন।
সিটি করপোরেশন এবং সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে নতুন করে জরিপকাজ চালানোর জন্য আইইডিসিআরের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলার ভারপ্রাপ্ত কীটতত্ত্ববিদ মো. মইনুদ্দিন বলেন, ফেব্রুয়ারিতে একটি জরিপকাজ করে গিয়েছে আইইডিসিআর। কিন্তু তখন মশার বিস্তার কম ছিল। নতুন একটি জরিপের জন্য যোগাযোগ করা হয়েছে। এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি কবে নাগাদ হতে পারে।
এদিকে সিটি করপোরেশন মশা নিধনে তিন মাস আগে বাকলিয়া এলাকায় একটি পরীক্ষামূলক প্রকল্প হাতে নিয়েছিল। ওই প্রকল্পে যুক্তরাষ্ট্রের একটি গবেষণাভিত্তিক নতুন মশা নিধন সমাধান বায়োলজিক্যাল লার্ভিসাইড ‘বিটিআই’ পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করছে। এতে ফল ভালো পেয়েছেন বলে দাবি করেছেন মেয়র শাহাদাত হোসেন। লার্ভিসাইড বিটিআই সব এলাকায় ব্যবহারের চিন্তাভাবনাও করপোরেশনের রয়েছে বলে শরফুল ইসলাম জানান।
সচেতনতায় জোর
ডেঙ্গু মোকাবিলায় সচেতনতায় জোর দিয়ে চলেছে দুই সংস্থা। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ডেঙ্গু মোকাবিলায় প্রচারপত্র বিতরণসহ নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে সিভিল সার্জন কার্যালয়। এই প্রচারপত্রে ময়লা–আবর্জনা পরিষ্কার রাখা, জ্বর হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়াসহ নানা সচেতনতামূলক বার্তা রয়েছে।
এ ছাড়া সিটি করপোরেশন জনসচেতনতা বাড়াতে এলাকাভিত্তিক প্রচারণা শুরু করেছে। নির্মাণাধীন ভবন, পরিত্যক্ত অবকাঠামো বা পণ্য এবং পানি জমে থাকে—এমন সরঞ্জাম অপসারণে এনফোর্সমেন্ট অভিযানও শুরু করবে বলে করপোরেশন সূত্র জানায়। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে অভিযান পরিচালনা করা হবে বলে জানান মেয়র শাহাদাত হোসেন।
এ ছাড়া সিটি করপোরেশন নগরের আলকরণে সদরঘাট জেনারেল হাসপাতালে বিনা মূল্যে ডেঙ্গু পরীক্ষার ব্যবস্থা করেছে। করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ইমাম হোসেন বলেন, ডেঙ্গু আইসোলেশন ওয়ার্ড খোলা হয়েছে। এ ছাড়া বিনা মূল্যে এনএস ১ অর্থাৎ ডেঙ্গু পরীক্ষা করা হচ্ছে। এ ছাড়া কোভিড-১৯–এর অ্যান্টিজেন পরীক্ষাও করপোরেশনের জেনারেল হাসপাতালে বিনা মূল্যে করা হয়েছে।
ডেঙ্গু না চিকুনগুনিয়া
চিকিৎসকেরা জানান, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া এডিস মশার কামড়ে হয়। দুই ধরনের জ্বরেই শরীরে ব্যথা হয়। তবে চিকুনগুনিয়ার ব্যথা মারাত্মক হয়। অনেক ক্ষেত্রে এই ব্যথা ১০ দিন থেকে এক মাস পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এবার চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ এক মাস ধরে বেশি বলে চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন। চিকুনগুনিয়ার ক্ষেত্রে ব্যথা বেশি হওয়ায় রোগীর নড়তেচড়তে কষ্ট হয়। চিকুনগুনিয়ায় শরীরে র্যাশও দেখা দেয়।
আর ডেঙ্গুর ক্ষেত্রেও তীব্র জ্বরের পাশাপাশি শরীর ব্যথা থাকে। এ ক্ষেত্রে রক্তে অণুচক্রিকা বা প্লাটিলেট কমে যায়। জ্বর আসার তিন দিনের দিন পরীক্ষায় ডেঙ্গু ধরা পড়ে। তবে চিকুনগুনিয়া কি না, তা জানতে এক সপ্তাহ পর অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করতে হয়। এই পরীক্ষায় অনেক সময় তা শনাক্ত করা যায় না।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আবদুস সাত্তার প্রথম আলোকে বলেন, এবার এখন পর্যন্ত চিকুনগুনিয়ার রোগী বেশি পাওয়া যাচ্ছে। এতে শরীরে তীব্র ব্যথা থাকে, বিশেষ করে জয়েন্টে। এই ব্যথা অনেক ক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী হয়। শরীরে র্যাশও আসে। তবে ডেঙ্গুও হচ্ছে। ডেঙ্গুতে প্লাটিলেট এবং রক্তচাপ কমে জীবনের ঝুঁকি দেখা দেয়। চিকুনগুনিয়ায় সেই ঝুঁকি নেই।
তিনি আরও জানান, ২০১৭ সালেও চিকুনগুনিয়া রোগী বেশি দেখা গিয়েছিল। সে বছর ডেঙ্গু রোগী কম ছিল। তবে যে জ্বরই হোক না কেন, স্বাস্থ্যকেন্দ্র কিংবা চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
এই দুই জ্বরের পাশাপাশি সাধারণ ভাইরাস জ্বর এবং করোনাও হচ্ছে বলে চিকিৎসকেরা জানান।
ডেঙ্গুর অতীত বর্তমান
এ বছর ৪৯৫ জন ডেঙ্গু রোগীর মধ্যে ২৮০ জনই বিভিন্ন উপজেলায় শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে বাঁশখালীতে সর্বোচ্চ ৮৬ জন ও সীতাকুণ্ডে ৬৩ জন ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যায়। মোট ডেঙ্গু রোগীর মধ্যে ২৭৮ জন পুরুষ, ১৩৫ জন নারী এবং ৮২ জন শিশু। ঘরের বাইরে অর্থাৎ স্কুল কিংবা খেলাধুলার জন্য মাঠে থাকার কারণে শিশুদের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় বলে চিকিৎসকেরা মনে করেন।
তবে তালিকার এই সংখ্যার বাইরে ডেঙ্গু রোগী থাকতে পারে বলে সিভিল সার্জন জাহাঙ্গীর আলম জানান। তিনি বলেন, ল্যাব কিংবা হাসপাতালগুলো প্রতিবেদন পাঠালে তা সমন্বয় করে তালিকা তৈরি করা হয়। যদি পাঠানো না হয়, সে ক্ষেত্রে রোগী বাইরে থেকে যাবে।
এ ছাড়া অনেক রোগী বাসাবাড়িতে চিকিৎসা নিয়ে থাকেন। তাঁদের হিসাবও সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তালিকায় আসে না। ফলে তালিকার বাইরেও রোগী থেকে যাচ্ছে এটা নিশ্চিত।
২০২৪ সালে চট্টগ্রামে ডেঙ্গু রোগী ছিল ৪ হাজার ৩২৩ জন। ওই বছর মারা গিয়েছিল ৪৫ জন। তার আগে ২০২৩ সালে মোট ১৪ হাজার ৮৭ ডেঙ্গু রোগী রেকর্ড করা হয়। এর মধ্যে মারা যান ১০৭ জন। ২০২২ সালে ৫ হাজার ৪৪৫ জন ডেঙ্গু রোগীর বিপরীতে মারা গিয়েছিলেন ৪১ জন।