ঘন জঙ্গল কেটে ও মাটি খুঁড়ে সন্ধান মিলল মসজিদের

শত শত মুসল্লি নিয়মিত নামাজ আদায় করেন এ মসজিদে। ২৪ মার্চ খুলনার কয়রা উপজেলার মসজিদকুঁড়ের মসজিদ
ছবি: ইমতিয়াজ উদ্দিন

সাত ফুট চওড়া চুন-সুরকির গাঁথুনির নান্দনিক ইটের দেয়াল। দেড় হাজার বর্গফুট আয়তনের মসজিদের ভেতর মাত্র চারটি পাথরের খুঁটির ওপর নয়টি সুদৃশ্য গম্বুজ। এভাবেই প্রাচীন ঐতিহ্য ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে মসজিদকুঁড়ের মসজিদ।

প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আজান শেষে শত শত মুসল্লি নিয়মিত নামাজ আদায় করেন এ মসজিদে। রমজানেও প্রতিদিন তারাবিহর নামাজ আদায় করা হয়। দূরদূরান্ত থেকে চমৎকার স্থাপত্যশৈলীর মসজিদটি দেখতে আসেন দর্শনার্থীরা।

অবস্থান ও নামকরণ

খুলনা শহর থেকে প্রায় ৯০ কিলোমিটার দক্ষিণে কয়রার আমাদি ইউনিয়নের সবুজে ঘেরা গ্রাম মসজিদকুঁড়। এই গ্রামের গা ঘেঁষে বয়ে যাওয়া কপোতাক্ষ নদের তীরে মসজিদটি অবস্থিত। ইট-সুরকির নির্মিত মসজিদটি দক্ষিণ বাংলার সবচেয়ে প্রাচীন প্রত্নসম্পদ। মসজিদের পাশে একটি সাইনবোর্ডে লেখা—প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে, ইংরেজি ১৪৫০ থেকে ১৪৯০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছে। সে হিসাবে মসজিদটির বয়স ৫০০ বছরের বেশি। প্রচলিত আছে, নির্মাণকালের প্রায় ৩০০ বছর পর জলদস্যুদের অত্যাচারে এ অঞ্চল জনমানবশূন্য হলে এটি ঘন জঙ্গলে পরিণত হয়। সে সময় নদীর জোয়ার-ভাটার পলিতে ঢাকা পড়ে যায় অনেক স্থাপনা। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ভারত বিভক্তির পর মসজিদটি আবার আবিষ্কৃত হয়। ঘন জঙ্গল কেটে ও মাটি খুঁড়ে মসজিদটি আবিষ্কার হওয়ায় নাম দেওয়া হয় মসজিদকুঁড়। সেই থেকে এ মসজিদের নামেই গ্রামটিও পরিচিতি পেয়েছে মসজিদকুঁড় নামে।

নির্মাণকাল

প্রাচীন মসজিদটির কোথাও কোথাও শ্যাওলা জমেছে।
ছবি: প্রথম আলো

জনশ্রুতি রয়েছে, ইংরেজি ১৪৫০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে হজরত খান জাহান আলী (রহ.) সদলবলে ঝিনাইদহের বারবাজার থেকে রওনা হয়ে যশোরের মুড়লি পর্যন্ত পৌঁছান। সেখান থেকে একদল সঙ্গী নিয়ে বাগেরহাটের দিকে রওনা দেন তিনি। এ সময় তাঁর বিশ্বস্ত সহচর বুড়া খাঁর নেতৃত্বে একটি দল দক্ষিণ দিকে সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকায় যায়। তাঁরা হজরত খানজাহান আলীর (রহ.) নির্দেশ ও দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে মসজিদকুঁড় থেকে বেদকাশি পর্যন্ত পথের বিভিন্ন স্থানে জলাশয় খনন, রাস্তা ও মসজিদ নির্মাণ করেন। তারই ধারাবাহিকতায় বুড়া খাঁ ও তাঁর ছেলে ফতেহ খাঁ মসজিদকুঁড়ের মসজিদটি নির্মাণ করেন।

মসজিদের পশ্চিম পাশে কপোতাক্ষ নদ ও অন্য তিন পাশে খাল ছিল। যার দুই পাশ বর্তমানে ভরাট করে বসতি গড়ে উঠেছে। ধারণা করা হয়, সে সময় মসজিদটির তিন পাশে বড় পরিখা খনন করা হয়েছিল। মসজিদের চতুর্দিকে কেন এত শক্ত প্রতিরক্ষা বলয় ছিল, তার ইতিহাস এখনো কেউ জানতে পারেনি। দেয়ালে কোনো শিলালিপি না পাওয়ায় নির্মাণকাল সম্পর্কে সঠিক ধারণা নেই। তবে বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদের সঙ্গে এ মসজিদের গঠনপ্রণালি ও স্থাপত্য কৌশলের সাদৃশ্য থাকায় এটি খানজাহান আলীর (রহ.) সময়ে নির্মিত বা সমসাময়িক বলে ধারণা করা হয়।

স্থাপত্যশৈলী

মসজিদের পাশে একটি ফলক আছে। সেখানে মসজিদ সংক্রান্ত তথ্য আছে।
ছবি: প্রথম আলো

বর্গাকার এ মসজিদের প্রতি পাশের দৈর্ঘ্য ১৬ দশমিক ৭৬ মিটার। ভেতরের দৈর্ঘ্য ১২ দশমিক ১৯ মিটার করে। মসজিদের অভ্যন্তরে রয়েছে চারটি স্তম্ভ। ইটের তৈরি ভিত্তি বেদির ওপরে প্রতিটি স্তম্ভ দুটি করে পাথরের সাহায্যে নির্মিত। এই চার স্তম্ভ মসজিদের ভেতরের অংশকে নয়টি সম বর্গক্ষেত্রে ভাগ করেছে। বর্গক্ষেত্রগুলো নয়টি গম্বুজ দিয়ে ঢাকা। মাঝখানের গম্বুজটি অন্যগুলোর চেয়ে আকারে কিছুটা বড়। পশ্চিম দিকের দেয়াল বাদে বাকি তিন দেয়ালে মসজিদে ঢোকার জন্য তিনটি করে প্রবেশদ্বার আছে।

মাঝের প্রবেশদ্বারগুলো অপেক্ষাকৃত বড়। কেবলামুখী দেয়ালের সঙ্গে রয়েছে অর্ধবৃত্তাকার একটি মিহরাব। মসজিদটি একসময় অনেক নকশা দিয়ে সজ্জিত ছিল। মসজিদের বাইরের দেয়াল দক্ষিণ, পূর্ব ও উত্তর দিকে পোড়ামাটির চিত্রফলক ছিল।

দর্শনার্থীদের কাছে মসজিদকুঁড় মসজিদের প্রধান আকর্ষণ এর অসাধারণ নান্দনিক নির্মাণশৈলী ও ছোট ছোট ইট দিয়ে চারদিকে সাত ফুট চওড়া দেয়াল আর নয়টি গম্বুজ। মসজিদটি বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের তত্ত্বাবধানে আছে।

২৪ মার্চ সকালে সরেজমিনে দেখা যায়, মসজিদের নকশা ও পলেস্তারা খসে পড়ছে। খিলান ও কার্নিশের ওপর আছে কিছু পোড়ামাটির চিত্রফলক। ভেতরে দেয়ালে সজ্জিত আছে পদ্মফুল, মালা, ঘণ্টাসহ বিভিন্ন প্রতিকৃতি।

মুসল্লি, ইমাম ও স্থানীয় বাসিন্দাদের ভাষ্য

দৃষ্টিনন্দন মসজিদকুঁড়ের মসজিদ
ছবি: প্রথম আলো

মসজিদকুঁড়ের মসজিদটি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের আওতায় থাকলেও এর রক্ষণাবেক্ষণ ও দেখাশোনার দায়িত্ব পালন করেন স্থানীয় মুসল্লিরা। তাঁরা জানান, মসজিদের মূল নকশার ক্ষতি না হয়, সেদিকে খেয়াল রেখে এর বাইরে কিছুটা সংস্কার করা হয়ে থাকে। তবে মূল দেয়াল এখনো অবিকৃত রয়েছে।

মসজিদের পাশের বাড়ির বাসিন্দা জুলফিকার আলী বলেন, গরমের সময়  প্রাচীনতম এ মসজিদের ভেতরটা বেশ ঠান্ডা থাকে। প্রাচীন এ মসজিদকে ঘিরে একসময় একটি চক্র গড়ে উঠেছিল। চক্রটি কুসংস্কারকে পুঁজি করে নানা কৌশলে টাকাপয়সা হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করত। স্থানীয় প্রশাসন ও গ্রামবাসীর হস্তক্ষেপে বর্তমানে তা নির্মূল হয়েছে।

মসজিদের বর্তমান ইমাম ইসমাইল হোসেন বলেন, শূন্য দশমিক ৪৫ একর জমির ওপর মসজিদটি প্রতিষ্ঠিত। মসজিদটির রক্ষণাবেক্ষণ ও দেখাশোনার দায়িত্বে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের একজন নিয়োগপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক আছেন। তিনি মাঝেমধ্যে আসেন। বাকি দায়িত্ব স্থানীয় মুসল্লিরাই পালন করেন।

মসজিদকুঁড় এলাকার স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জিয়াউর রহমান বলেন, এটি শুধু মসজিদ নয়। এটি প্রতিষ্ঠানও। দেশি-বিদেশি অনেকেই প্রাচীন এ নিদর্শন দেখতে আসেন। তবে পুরো মসজিদকে একটি কমপ্লেক্স হিসেবে গড়তে পারলে এটি হতে পারে দেশের অন্যতম দর্শনীয় স্থান।

স্থানীয় সংসদ সদস্য মো. আকতারুজ্জামান বলেন, ইতিমধ্যে মসজিদকুঁড় মসজিদটিকে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার আশ্বাস দিয়েছে। এখানে পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলা হলে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আনাগোনা বেড়ে যাবে। এ জনপদের মানুষ উপকৃত হবে।