সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেনের ‘এমপি লীগ’

সংসদ সদস্য হওয়ার পর দলে একটি পক্ষ তৈরি করেছেন। পরিবারের সদস্য দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করেন এলাকার জলমহাল ও বালুমহাল।

সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেনের বাড়ি ‘হাওর বাংলা’। সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার নওধার গ্রামে
ছবি: খলিল রহমান

২০০৮ সালে সংসদ নির্বাচনের আগে আগে সুনামগঞ্জের ধর্মপাশায় একটি প্রচারপত্র ছাড়েন মোয়াজ্জেম হোসেন ওরফে রতন। বিষয়—উপজেলা চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হতে আগ্রহী। কিন্তু এলাকায় অচেনা ‘রতনকে’ আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা-কর্মীরা মেনে নিতে পারেননি। এরপর সংসদ নির্বাচনের সময় সবাইকে তাক লাগিয়ে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে এলাকায় হাজির হন তিনি।

এরপর ১৫ বছর সুনামগঞ্জ-১ (তাহিরপুর-ধর্মপাশা-জামালগঞ্জ) আসনে নিজের একটি পক্ষ তৈরি করেছেন সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন। দলের নেতা-কর্মীরা নাম দিয়েছেন, ‘এমপি লীগ’। তাঁর দাপটে কোণঠাসা দলের অন্য নেতারা। ‘এমপি লীগে’ না থাকায় অনেকে স্থানীয় সরকারে নৌকার মনোনয়নে নির্বাচন করেও হেরেছেন।

মোয়াজ্জেম হোসেন সংসদ সদস্য হওয়ার পর আত্মীয়স্বজনদের অনেকে দলের পদ পেয়েছেন। অন্য দলের লোকজনকে নিজের স্বার্থে দলে যুক্ত করেছেন। দুর্নীতি, হাওরের জল ও বালুমহাল নিয়ন্ত্রণ, ফসল রক্ষা বাঁধের প্রকল্পের টাকায় ভাগ, অন্যের জমি দখলসহ নানা অভিযোগে অভিযুক্ত তিনি। একসময় তেমন কোনো সম্পদ না থাকলেও মোয়াজ্জেম হোসেন এখন অঢেল সম্পদের মালিক।

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে মোয়াজ্জেম হোসেন দলীয় মনোনয়ন পাননি। তবে তিনি স্বতন্ত্র নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছেন। গত রোববার সংসদ সদস্যের ব্যক্তিগত সহকারী আবদুর রাজ্জাকের ফেসবুক আইডি থেকে ভিডিও বার্তায় তিনি এ ঘোষণা দেন। গত মঙ্গলবার তিনি মনোনয়নপত্র নিয়েছেন। এই আসনে সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রনজিত চন্দ্র সরকার দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন।

জলমহাল, বালুমহাল নিয়ন্ত্রণ

সুনামগঞ্জ-১ আসনে বড় বড় জলমহাল ও বালুমহাল আছে। সংসদ সদস্য হওয়ার পর ধীরে ধীরে এসবের নিয়ন্ত্রণ নিতে থাকেন মোয়াজ্জেম হোসেন। স্বজনদের যুক্ত করেন ভাগবাঁটোয়ারায়। প্রকাশ্যে নিজের নাম না থাকলেও উপজেলা পর্যায়ে কেউ এসব জলমহালের ইজারা নিতে চাইলে সংসদ সদস্য কিংবা তাঁর স্বজনদের ভাগ দিতে হয়। জলমহাল নিয়ে খুনাখুনিও হয়েছে।

এলাকার বৃহৎ জলমহাল সুনইয়ে তাঁর পরিবারের অংশীদারত্ব আছে। ২০২১ সালের ৭ জানুয়ারি এই জলমহালে সংসদ সদস্যের ছোট ভাই ধর্মপাশা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা যুবলীগের সভাপতি মোজাম্মেল হোসেন ওরফে রোকনের সমর্থক হিসেবে পরিচিত একদল লোক হামলা করে। তখন অস্ত্রের আঘাতে সুনই মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সদস্য শ্যামাচরণ বর্মণ (৬৫) নিহত হন। শ্যামাচরণের ছেলে চন্দন বর্মণ থানায় সংসদ সদস্যসহ ৬৩ জনের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দিলেও পুলিশ মামলা নেয়নি। পরে অজ্ঞাতনামা কয়েকজনের বিরুদ্ধে একটি মামলা করে পুলিশ।

গত বছর জালধার, বারিয়ানদী ও কোদালিয়া-পেকুয়া দেবুয়ার খাল জলমহাল নির্ধারিত সময়ের প্রায় সাত মাস পর ইজারা হয়। মোয়াজ্জেম হোসেন এসব জলমহাল নিজের লোকদের পাইয়ে দিতে প্রশাসনকে চাপ দিয়ে নির্ধারিত সময়ে ইজারা দিতে দেননি। এলাকার অন্যান্য জলমহালগুলোও তাঁর ইশারা ছাড়া ইজারা দেওয়া যায় না বলে অভিযোগ আছে।

সুনামগঞ্জের সবচেয়ে বড় বালুমহাল তাহিরপুরের জাদুকাটা নদী। সেখানে নামে-বেনামে যুক্ত মোয়াজ্জেম হোসেন। সেখানে অবাধে বালু উত্তোলন চলে। সীমানার বাইরে থেকেও বালু-পাথর উত্তোলন করা হয়। অনিয়ন্ত্রিতভাবে বালু তোলায় নদীভাঙন ও পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে।

মোয়াজ্জেম হোসেন অবশ্য অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, ‘জলমহাল ও বালুমহাল তো প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করবে। তাঁদের জিজ্ঞাসা করলেই জানতে পারবেন, আমি এসবে নেই।’

মোয়াজ্জেমের ‘এমপি লীগ

মোয়াজ্জেম হোসেন

মোয়াজ্জেম হোসেন সংসদ সদস্য হওয়ার পর দলের নেতা-কর্মীদের বাদ দিয়ে আত্মীয়স্বজন ও অন্য দলের লোকজনকে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের পদ দিতে থাকেন। তিনি নিজে ধর্মপাশা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। বড় ভাই মোশারফ হোসেন উপজেলা আওয়ামী লীগের ধর্ম সম্পাদক। ছোট ভাই মোজাম্মেল হোসেন উপজেলা যুবলীগ সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান। চাচা মাফিজ আলী পাইকুরাটি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। আরেক চাচা রমজান আলী জয়শ্রী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি। চাচাতো ভাই নূর জামাল জাতীয় শ্রমিক লীগের উপজেলার সহসভাপতি। আরেক চাচাতো ভাই সোহরাব মিয়া পাইকুরাটি ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি। ভাতিজা তানভির হাসান উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক। চাচাতো ভাই সোফেল আহমদ উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক।

মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘আমি এলাকায় ৪০টি দলীয় কার্যালয় করেছি। এলাকায় অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে দল শক্তিশালী ও সংগঠিত। এলাকায় এমপি লীগ বলে কিছু নেই, যা আছে আওয়ামী লীগ।’

নৌকার বিরোধিতা

গতবার ধর্মপাশা উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে নৌকার মনোনয়ন পান উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শামীম আহমেদ। কিন্তু নির্বাচনে ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী হন মোয়াজ্জেমের ছোট ভাই উপজেলা যুবলীগের সভাপতি মোজাম্মেল হোসেন। অভিযোগ আছে, মোয়াজ্জেম ভাইয়ের পক্ষে নির্বাচনে প্রভাব খাটান। নির্বাচনে নৌকাকে হারিয়ে মোজাম্মেল হোসেন জয়ী হন।

শামীম আহমদের অভিযোগ, সংসদ সদস্য ভাইকে জেতাতে নৌকাকে ডুবিয়েছেন। সংসদ সদস্যের বাড়ির কেন্দ্রে এক শর কম ভোট পান তিনি। অথচ ঘোড়া প্রতীকে ভোট পড়ে দুই হাজারের বেশি। তিনি বলেন, প্রতিটি নির্বাচনে তিনি (মোয়াজ্জেম) নৌকার বিরুদ্ধে নিজের প্রার্থী দেন।

সব৴শেষ ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে ধর্মপাশার কয়েকটি ইউনিয়নে মোয়াজ্জেমের পক্ষে না থাকায় নৌকা প্রতীকের কয়েকজন প্রার্থী জিততে পারেননি। এর মধ্যে সংসদ সদস্যের নিজের ইউনিয়ন পাইকুরাটিও আছে। সদর ইউনিয়ন পরিষদে সংসদ সদস্যের বিরোধিতার পরও জয়ী হন জুবায়ের পাশা। তিনি বলেন, ‘আমি নৌকা নিয়ে জয়ী হয়েছি। কিন্তু সংসদ সদস্য এখানে প্রকাশ্যে আমার বিরোধিতা করেছেন। দলের আরেক নেতাকে বিদ্রোহী প্রার্থী করেন।’

 পাইকুরাটি ইউপি নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী এম এম এ রেজার অভিযোগ, সংসদ সদস্যের সঙ্গে না থাকায় তিনি বিরোধিতা করেন। মাত্র ২০০ ভোটে তিনি হেরেছেন। সংসদ সদস্যের কেন্দ্রে তিন হাজার ভোটের মধ্যে নৌকা পেয়েছে মাত্র ৫৪টি। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন।

হাওরে বাঁধের টাকায় ভাগ

সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলায় ফসল রক্ষায় প্রতি বছর প্রায় ২০০ বাঁধের কাজ হয়। এসব প্রকল্প থেকে সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন ও তাঁর ভাই উপজেলা চেয়ারম্যান মোজাম্মেল হোসেনের ভাগ নেওয়ার অভিযোগ আছে। গত বছর হাওরের বাঁধ ভেঙে ফসলহানি ঘটলে পানিসম্পদ উপমন্ত্রী পরিদর্শনে এলে তাঁর সামনে এক কৃষক অভিযোগ করেন, হাওরে বাঁধের প্রতিটি প্রকল্পের জন্য সংসদ সদস্য ও তাঁর ভাইকে টাকা দিতে হয়। এ জন্য বাঁধের কাজ ঠিকমতো হয় না।

মোয়াজ্জেম ও তাঁর ভাই সব৴শেষ বিতর্কের জন্ম দেন মধ্যনগর উপজেলায় সরকারি প্রকল্পে নির্মিত বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যে তাঁদের ছবি জুড়ে দিয়ে। নকশা অনুযায়ী এক পাশে বঙ্গবন্ধু ও অন্য পাশে প্রধানমন্ত্রীর ছবি থাকার কথা ছিল। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ছাড়াই সংসদ সদস্য ও তাঁর ছোট ভাইয়ের ছবি যুক্ত করা হয়। একটি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ভাস্কর্য থেকে সেই ছবি অপসারণের নির্দেশ দেন উচ্চ আদালত।

অভিযোগের বিষয়ে মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘যে লোক অভিযোগ করেছেন, সে আসলে বিএনপির লোক। কারও প্ররোচনায় মিথ্যা অভিযোগ করেছিলেন। বাঁধের কাজে আমি বা আমার পরিবার কখনো সম্পৃক্ত ছিলাম না।’

গ্রামে বিলাসবহুল অট্টালিকা

২০০৮ সালে নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হলফনামায় সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেনের বাড়ি বলতে নওধার গ্রামে পৈতৃক টিনশেডের একটি বাড়ি ছিল। ১০ বছরের ব্যবধানে তিনি তিনটি বাড়ি, ঢাকায় বড় অ্যাপার্টমেন্টের মালিক হয়েছেন।

২০১৮ সালে নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হলফনামায় এমন তথ্য পাওয়া যায়। ২০০৮ সালে তাঁর কৃষিজমি ছিল ৩ দশমিক ৯৩ একর ও অকৃষিজমি ১ দশমিক ১৫ একর। বার্ষিক আয় ছিল কৃষি ও ব্যবসায় ৫ লাখ ৪৭ হাজার টাকা। ২০১৮ সালে কৃষিজমি বেড়ে ৫২৩ দশমিক ২৭ একর ও অকৃষিজমি ৮ দশমিক ২৬ একর হয়। ১০ বছরে বার্ষিক আয় বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৩৪ লাখ টাকা।

মোয়াজ্জেম নিজ গ্রামে বানিয়েছেন বিলাসবহুল অট্টালিকা, নাম দিয়েছেন ‘হাওর বাংলা’। জেলা শহরে কিনেছেন নতুন বাড়ি। এ ছাড়া কানাডায় বাড়ি ও বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগ আছে তাঁর বিরুদ্ধে। ২০১৯ সালে অর্থ পাচার ও জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মোয়াজ্জেমকে তলব করেছিল দুদক।

দুর্নীতির অভিযোগ সঠিক নয় দাবি করে মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, দুদক তদন্ত করে কিছুই পায়নি। তাঁর সম্পদের হিসাব পরিষ্কার। সব হিসাব আয়কর ফাইলে উল্লেখ আছে। বিদেশে কোনো বাড়ি নেই। টাকাও পাচার করেননি।

অবশ্য উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক শামীম আহমেদ মনে করেন, গত পাঁচ বছরে মোয়াজ্জেম হোসেন দলের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করেছেন। তিনি ‘এমপি লীগ’ নামে পরিচিতি পেয়েছেন। শামীম আহমেদ বলেন, একসময় খালি হাতে ধর্মপাশায় এসেছিলেন মোয়াজ্জেম হোসেন। সংসদ সদস্য হয়ে তাঁর দিন বদলে গেছে।

এলাকায় জলমহাল, বালুমহাল, টিআর-কাবিখা, হাওরের বাঁধ সবই নিয়ন্ত্রণ করেছেন। তাঁর অনিয়ম, দুর্নীতি, দখল, নেতা-কর্মীদের হয়রানি সব মানুষ জানে। আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে গড়েছেন এমপি লীগ। প্রতিটি স্থানীয় নির্বাচনেই নৌকার বিরোধিতা করেছেন। নৌকা ডু্বিয়েছেন। নেত্রীর কাছে সব খবর গেছে। যে কারণে এবার মনোনয়ন পাননি। এতে দলের নেতা-কর্মীসহ সাধারণ মানুষ স্বস্তি পেয়েছেন।