রমজানে ব্যস্ততা বেড়েছে সখীপুরের মুড়ির গ্রামগুলোতে

রমজান মাসে হাতে ভাজা মুড়ির চাহিদা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। তাই এ সময় দম ফেলার ফুসরত পাচ্ছেন না মুড়ি ভাজার সঙ্গে জড়িত নারীরা। গতকাল শুক্রবার উপজেলার কালিদাস নমপাড়া গ্রামেছবি: প্রথম আলো

ইফতারের প্লেটে অন্যতম এক অনুসঙ্গ মুড়ি। আর সেই মুড়ি যদি হয় হাতে ভাজা, তাহলে তো সোনায় সোহাগা। তাই পবিত্র রমজান এলেই হাতে ভাজা মুড়ির চাহিদা কয়েক গুণ বেড়ে যায়। টাঙ্গাইলের সখীপুরের বেশ কয়েকটি গ্রামের একেকটি বাড়ি যেন হাতে ভাজা মুড়ির কারখানা। এ গ্রামগুলোকে উপজেলার অনেকেই ‘মুড়ির গ্রাম’ হিসেবেই চেনেন। রমজান মাসে এই মুড়ির চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় গ্রামগুলোতে মুড়ি ভাজার ধুম পড়ে গেছে। তবে উৎপাদন খরচ আর পরিশ্রমের তুলনায় এখন আর তেমন লাভ হয় না বলে দাবি করছেন এই ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।  

উপজেলার কালিদাস মন্দিরপাড়া, নমপাড়া, বেড়বাড়ী, রতনপুর ও কৈয়ামধু গ্রামের অনেক নারী–পুরুষ মুড়ি ভেজে সংসার চালান। তাঁদের দাবি, এই মুড়িতে কোনো ভেজাল দেওয়া হয় না। তাই টাঙ্গাইল ছাড়াও ঢাকা, গাজীপুর ও ময়মনসিংহসহ আশপাশের এলাকায় এই মুড়ির চাহিদা আছে।  

গতকাল শুক্রবার সকাল নয়টার দিকে কালিদাস নমপাড়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, জয়মালা রানী সরকার নামের ষাটোর্ধ্ব এক নারী মাটির হাঁড়িতে মুড়ি ভাজছেন। সঙ্গে তাঁর বৃদ্ধ স্বামী সুনীল সরকার সহযোগিতা করছেন। জয়মালা রানী চাল ভাজছেন। চালের সঙ্গে লবণের পানি মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। আরেকটি চুলায় বড় একটি হাঁড়িতে বালু গরম করছেন তাঁর স্বামী সুনীল সরকার। একপর্যায়ে চাল ও বালু গরম হলে চাল তুলে বালুর হাঁড়িতে ঢেলে দেওয়া হয়। জয়মালা রানী তখন বালুর হাঁড়িটি ঘোরাতে থাকেন।

প্রায় ৩০ সেকেন্ডের ভেতর সেই হাঁড়িতে চাল ফুটে মুড়ি তৈরি হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে হাজার ফোঁড়ের একটি হাঁড়িতে (স্থানীয় ভাষায় ঝাঁজর) বালুসহ মুড়ি ঢেলে দেওয়া হয়। ওই ঝাঁজরে মুড়ি আটকা পড়ে আর ফোঁড়ের ভেতর দিয়ে বালু নিচের পাতিলে ঝরে পড়ে। এভাবেই তৈরি হয় হাতে ভাজা মুড়ি।

দুর্গা রানী বলেন, বর্তমানে ধানের দাম অনেক বেশি। এক মণ ধানের দাম ১৫০০ থেকে ১৬০০ টাকা। মুড়ি বানাতে গেলে ওই ধান দুইবার করে সেদ্ধ করতে হয়। এক মণে মুড়ি হয় ২৩ থেকে ২৪ কেজি। ভোর থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত একটানা মুড়ি ভাজলে দিনে প্রায় দুই মণ চালের মুড়ি ভাজা যায়। এতে এক দিনে দুজনে মিলে ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা আয় করা যায়। তবে এই আয় দিয়ে পোষাচ্ছে না। খরচ আর পরিশ্রমের তুলনায় তেমন লাভ হচ্ছে না।

একই গ্রামের সুভাস সরকার হাতে ভাজা মুড়ি বিক্রি করেন। তিনি বলেন, ‘আমি গ্রাম থেকে ৯০ টাকা কেজি দরে মুড়ি কিনি। এর পর এই মুড়ি সখীপুরে নিয়ে ১০০ টাকায় বিক্রি করি। সখীপুরের ব্যবসায়ীরা আবার ১২০ টাকা দরে বেচেন। বাজারের কারখানার মুড়িতে ভেজাল আছে শুনেছি, তবে আমাদের হাতে ভাজা মুড়িতে কোনো ভেজাল নেই।’

সখীপুরের বেশ কয়েকটি গ্রামের একেকটি বাড়ি যেন হাতে ভাজা মুড়ির কারখানা
ছবি: প্রথম আলো

উপজেলার কৈয়ামধু গ্রামের বাজারের পাশেই আলাউদ্দিনের বাড়ি। দুজনেই মুড়ি ভাজার কাজ করেন। বাড়িতে ঢুকতেই দেখা গেল, দুজনে মিলেমিশে মুড়ি ভাজছেন। আলাউদ্দিন মুড়ির চাল ভাজছিলেন, তাঁর স্ত্রী ফাহিমা আক্তার বালুর পাতিল গরম করছিলেন।

আলাউদ্দিন বলেন, রমজান মাস এলেই আমাদের ভাজা মুড়ির চাহিদা বাড়ে। তবে কষ্ট অনুপাতে লাভ হয় না। দুই মণ চালের মুড়ি ভাজতে এক কেজি লবণ লাগে। ৫০০ টাকার লাকড়ি খরচ হয়। তবে যে পরিশ্রম হয়, তাতে টাকায় পোষে না।

সখীপুরের মুড়ি ব্যবসায়ী তমিজ উদ্দিন বলেন, হাতে ভাজা মুড়ির চাহিদা সারা বছর থাকলেও রমজান মাসে এর পাঁচ গুণ চাহিদা বাড়ে। ফলে এ মাসে লাভ হয়। তবে অন্য মাসে চাহিদা কম থাকে। এ ছাড়া ধান, লবণ, জ্বালানি—সবকিছুরই দাম বাড়তি। দিনশেষে সব খরচ বাদ দিয়ে খুব বেশি লাভ থাকে না, তাই অনেকেই মুড়ি ভাজার কাজ ছেড়ে দিয়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন।