ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং
‘নতুন করে আবাদ করার সামর্থ্য নেই’
শীতকালীন আগাম সবজির জমিগুলোতে পানি জমে আছে। কোনো কোনো জমির সবজির গাছ মরতে শুরু করেছে।
কৃষিতে বিশেষ অবদান রাখায় ১২ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার (ব্রোঞ্জপদক) পান নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার কৃষক সফিকুল ইসলাম। এর পর থেকেই তাঁর বাড়িতে ছিল উৎসবের আনন্দ। তবে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং সফিকুলের সেই আনন্দ ফিকে করে দিয়েছে। টানা বৃষ্টি ও জোয়ারের প্রভাবে মেঘনা নদীর পানিতে তাঁর প্রায় ১০ বিঘা জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একই অবস্থা আরও অনেক কৃষকের। তাঁদের সবাই মূলত সবজিচাষি।
গতকাল মঙ্গলবার আড়াইহাজারের হাইজাদী ইউনিয়নের সরাবদী এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বিঘার পর বিঘা সবজির জমি ও বীজতলায় পানি জমে আছে। মাত্র এক দিনের পানিতে কোনো কোনো জমির সবজির চারা মরতে শুরু করেছে। কিছু কিছু বীজতলা পুরোপুরি পানির নিচে চলে গেছে।
ভুক্তভোগী ব্যক্তিরা বলছেন, ঘূর্ণিঝড়ে কেবল কৃষকেরাই ক্ষতিগ্রস্ত হননি, ক্রেতাদেরও এর জের টানতে হবে। নতুন করে বীজতলা তৈরি এবং সবজির চারা রোপণের পর তা বাজারে আসবে স্বাভাবিক সময়ের বেশ কিছুদিন পর। ততদিন বাজারে সবজির দাম বেশি থাকবে।
জমির পাশেই কথা হয় সফিকুলের সঙ্গে। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘কী করব কিছু মাথায় আসছে না। প্রায় সাড়ে চার বিঘা জমিতে আগাম জাতের লাউ, মিষ্টিকুমড়া ও বেগুন আবাদ করেছি। গত মাসের মাঝামাঝি সময়ের বৃষ্টিতে সেগুলোর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। তারপর নতুন করে আবার আবাদ করি। টানা ২৪ ঘণ্টার বৃষ্টিতে সেসব সবজির জমিতে পানি লেগে গাছ মরতে বসেছে।’
একই অবস্থা মানিকগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ ও গাজীপুরের কৃষকদেরও। এসব এলাকায় বেগুন, শসা, ফুলকপি, বাঁধাকপি, করলা, ঢেঁড়স, মুলা, বরবটি, লাউ, কুমড়াসহ বিভিন্ন সবজির আবাদ করেছেন কৃষকেরা। এসব জমিতে পানি জমে আছে। জলাবদ্ধতায় বেশির ভাগ সবজির গাছ অনেকটা ঝুলে পড়ছে।
মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার বাসুদেবপুর গ্রামের কৃষক বছির উদ্দিন (৬০) বলেন, ‘দেড় বিঘা জমিতে শসা আবাদ করছি। বেশ শসা ধরেছে গাছে। মাত্র দুবার শসা তুলেছি। এর মধ্যে ঝড়-বৃষ্টিতে শসার জাংলা (মাচা) ভেঙে মাটিতে মিশে গেছে, খেতে জমেছে পানি।’
মানিকগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য থেকে জানা গেছে, এ বছর জেলায় ৩ হাজার ৫৬ হেক্টর জমিতে শীতকালীন আগাম সবজির আবাদ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৭০ হেক্টর জমির সবজি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। অবশ্য জেলা কৃষি কর্মকর্তাদের ভাষ্য, জমি থেকে তিন-চার দিনের মধ্যে পানি বের করতে পারলে সবজি গাছের তেমন ক্ষতি হবে না।
মুন্সিগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, জেলায় ইতিমধ্যে ৩৮৭ হেক্টর জমিতে আগাম সবজির চাষ হয়েছে। সবচেয়ে বেশি মুন্সিগঞ্জ সদর, টঙ্গিবাড়ী ও সিরাজদিখান উপজেলায় চাষ হয়েছে। এর মধ্যে ১৯০ হেক্টর জমি ঘূর্ণিঝড়ে আক্রান্ত হয়েছে।
৫০ হাজার টাকা ধারদেনা করে ৬০ শতাংশ জমিতে লাউ, লালশাক, বাঁধাকপি, ডাটাশাক চাষ করেছিলেন সদর উপজেলার উত্তর মহাখালী এলাকার কৃষক শাহ আলম। এসব জমিতে এখন হাঁটু পানি। চোখের পানি মুছতে মুছতে শাহ আলম বলছিলেন, ‘ঘূর্ণিঝড়ে সব শেষ কইরা দিল। নতুন করে আবাদ করব সে সামর্থ্য নেই।’
গাজীপুরের কাপাসিয়া ও শ্রীপুরের ভিন্ন এলাকায় মাঠের পর মাঠ চাষ করা হয়েছে আমন ধান। ঘূর্ণিঝড়ের সময় দমকা হাওয়ায় ধানের গাছ মাটিতে নুইয়ে পড়েছে। এতে কাঙ্ক্ষিত ফলন পাওয়া যাবে না বলে জানিয়েছেন কৃষকেরা। কাপাসিয়া উপজেলার সনমানিয়া ইউনিয়নের আড়াল গ্রামের কৃষক হারিস উদ্দিন বলেন, ‘সকালে ঘুম থেকে উইঠা দেখি কাঁচা ধান গাছ সব মাটিতে শোয়া। অর্ধেক ধানও পাওয়া যাবে না।’
[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন প্রতিনিধি,মানিকগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, শ্রীপুর ও সংবাদদাতা, নারায়ণগঞ্জ]