‘আমি কিচ্ছু চাই না, শুধু আমার বাপটার লাশটা আইনা দেন’

বৃহস্পতিবার দুপুরে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার ব্রক্ষ্মতল এলাকায় বাড়ির উঠানে বসে কেঁদে কেঁদে ছেলের কথা বলছেন বিএসএফের গুলিতে নিহত ইয়াসিন আলীর মা জবেদা বেগম (বাঁ থেকে দ্বিতীয়)। পেছনে দাঁড়িয়ে কাঁদছেন বাবা কিতাব আলী
ছবি: রাজিউর রহমান

‘আমি কিচ্ছু চাই না, আপনেরা শুধু আমার বাপটার লাশটা আইনা দেন। আমার বাপেরে যারা ডাইকা নিয়া গেছে, আমি তাগোর (তাদের) বিচার চাই। মাত্র একটা মাস হইল আমার বাপটা বিয়া করছে। ওর বউরে আমি কী সান্ত্বনা দিব! আর যেন কোন মায়ের বুক এইভাবে খালি না হয়।’

আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে বাড়ির উঠানে বসে এভাবেই কান্না করতে করতে আকুতি করছিলেন বিএসএফের গুলিতে নিহত তরুণ ইয়াসিন আলীর (২৩) মা জবেদা বেগম। এ সময় তাঁকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন বাড়িতে আসা স্বজনেরা। এ সময় ঘর থেকে ইয়াসিন আলী একটি লেমিনেটিং করা ছবি আর বিয়ের কাগজপত্র বের করে এনে দেখালেন ইয়াসিনের নববিবাহিত স্ত্রী (আফরোজা কলি)। ছবি দেখিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠে ইয়াসিনের স্ত্রী বলতে শুরু করলেন, ‘ঈদের দুই দিন আগে আমাদের বিয়ে হয়েছে। মাত্র এক মাসেই মানুষটাকে হারিয়ে ফেললাম। এখন কী হবে আমার! আমার স্বামীর লাশটা কি আমরা পাব না?’

নিহত দুজন হলেন পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার তেঁতুলিয়া সদর ইউনিয়নের মাগুরা এলাকার জয়নাল আবেদীনের ছেলে আবদুল জলিল (২৪) ও একই উপজেলার তিরনইহাট ইউনিয়নের ব্রহ্মতল এলাকার কিতাব আলীর ছেলে ইয়াসিন আলী। নিহত জলিল ও ইয়াসিন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন।

বিজিবি, স্থানীয় লোকজন ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত মঙ্গলবার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার পর তেঁতুলিয়ার খয়খাটপাড়া সীমান্ত এলাকার ৪৪৬ নম্বর মেইন পিলারের ১৪ (আর) এলাকায় বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত এলাকায় বিএসএফের গুলিতে ওই দুই তরুণ নিহত হন। ঘটনার পর গতকাল বুধবার ভোরে ভারতের বিএসএফের ১৭৬ ব্যাটালিয়নের ফকিরপাড়া ক্যাম্পের সদস্যরা তাঁদের লাশ নিয়ে যান। এ সময় ওই দুই তরুণের সঙ্গে থাকা অন্যরা পালিয়ে এসে বিষয়টি নিহত ব্যক্তিদের পরিবারকে জানান। পরে তাঁরা জনপ্রতিনিধিদের ও বিজিবিকে বিষয়টি জানান।

এ ঘটনায় বুধবার সকালে ও দুপুরে ওই সীমান্তে বিজিবি-বিএসএফের দুই দফায় পতাকা বৈঠক হয়। এ বৈঠকে বিজিরি পক্ষ থেকে এ ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে লাশ ফেরত চাওয়া হয়েছে। দুপুরে দ্বিতীয় দফায় ব্যটালিয়ন পর্যায়ের পতাকা বৈঠকে বিএসএফ এ ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছে এবং আইনি প্রক্রিয়া শেষে লাশ ফেরত দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে। তবে বিএসএফ আত্মরক্ষার্থে গুলি চালিয়েছে বলে পতাকা বৈঠকে দাবি করেছে, এমনটা জানিয়েছে বিজিবি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০ শতক ভিটেবাড়ি ছাড়া আর কোনো জমিজমা নেই ইয়াসিন আলীদের। দুই ভাই দুই বোনের মধ্যে সবার বড় ইয়াসিন আলী দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন। বাবার সঙ্গে মহানন্দা নদীতে নুড়ি পাথর তোলার কাজ করতেন ইয়াসিন। প্রায় তিন বছর আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের মাধ্যমে বরগুনার পাথরঘাটার এক তরুণীর সঙ্গে পরিচয় হয় ইয়াসীন আলীর। এরপর গত ৯ এপ্রিল ঈদুল ফিতরের দুই দিন আগে ওই তরুণী ইয়াসিনের বাড়িতে চলে আসেন। পরে পারিবারিকভাবে বিয়েও হয় তাঁদের। কিন্তু বিয়ের ঠিক এক মাসের মাথায় স্বামীকে হারিয়ে এখন দিশেহারা হয়ে পড়েছেন ওই তরুণী।

এদিকে বৃহস্পতিবার বিকেলে তেঁতুলিয়া সদর ইউনিয়নের মাগুরা এলাকায় নিহত জলিলের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বারান্দায় বসে ছেলের শোকে কাতর হয়ে বসে আছেন মা জহুরা খাতুন। জলিলের বাবা জয়নাল আবেদীন জানান, তাঁর ছেলে এইচএসসি পাস করেছিল। এরপর করোনার সময় তাঁর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। বাবার সঙ্গে কৃষিকাজ করতেন জলিল। মঙ্গলবার বিকেলে জলিলের বন্ধু ইয়াসিন আলী ও অপর এক লোক এসে জলিলকে নিয়ে যান। পরদিন সকালে তাঁরা খবর পান, জলিল ভারতে বিএসএফর গুলিতে মারা গেছেন।

জলিলের বাবা জয়নাল আবেদীন বলেন, ‘আমার দুই ছেলে দুই মেয়ের মধ্যে জলিল সবার বড়। এর মধ্যে একটা মেয়ে প্রতিবন্ধী। অল্প কিছু জমিতে আবাদ করি আর অন্যের কৃষিকাজ করে সংসার চালাই। ছোট ছেলেটা ঢাকায় পোশাক কারখানায় কাজ করে। জলিলকে হারিয়ে আমার সব আশা শেষ হয়ে গেল।’

এদিকে ইয়াসিনের বাবা কিতাব আলী বলেন, ‘আমার ছেলে তো মারা গেছে। তাঁকে তো আর ফিরে পাব না। এখন শুধু ওর লাশের অপেক্ষায় আছি। লাশ আনার জন্য কিছু কাগজপত্র বিজিবি সদস্যরা নিয়েছেন। তবে আমার ছেলেকে যারা বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গেছে, তাদের কাছেই হয়তো তার মোবাইল ফোন (জলিলের মুঠোফোন) আছে। তাদের ধরলে সব সত্য ঘটনা জানা যাবে।’

বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) পঞ্চগড় ১৮ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল যুবায়েদ হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘নিহত দুজনের লাশ ফেরত আনার জন্য আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এ বিষয়ে ইতিমধ্যে বিএসএফের সঙ্গে কথাও হয়েছে। শুক্রবার লাশ ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা আছে।’