কুষ্টিয়ায় লাঠিয়াল বাহিনীর ৯ দশক পূর্তির উৎসবে ‘শিকড় না ভোলার প্রত্যয়’

লাঠিখেলায় অংশ নিয়েছেন মনজুরীন সাবরিন চৌধুরী। বৃহস্পতিবার বিকেলে কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ মাঠেছবি: তৌহিদী হাসান

লাঠি হাতে সারিতে দাঁড়িয়ে আছেন ৭০ বছরের আজিজল বিশ্বাস। পাশেই আরেক সারিতে দাঁড়িয়ে ১০ বছরের ইমরান হোসেন, তার হাতেও লাঠি। দুজনই লাঠিয়াল। বয়োবৃদ্ধ হলেও লাঠির ভরে দাঁড়িয়ে নয়, বরং প্রতিপক্ষকে শক্ত হাতে দমন করতে লাঠির কৌশল দেখাতে এসেছেন আজিজল। একই উদ্দেশ্যে এসেছে শিশু লাঠিয়াল ইমরান।

আজিজল বিশ্বাস ও ইমরানের মতো পাঁচ শতাধিক লাঠিয়াল জড়ো হয়েছেন কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ মাঠে। সেখানে শুরু হয়েছে তিন দিনব্যাপী ‘ওস্তাদ ভাই লাঠিখেলা উৎসব ও লোকজ মেলা’। ৯ দশক পূর্তি উপলক্ষে বাংলাদেশ লাঠিয়াল বাহিনী এই আয়োজন করেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে আনুষ্ঠানিকভাবে উৎসবের উদ্বোধন করেন কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক শিশির কুমার রায়। জাতীয় সংগীত ও জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে উৎসব ও মেলার আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়।

আরও পড়ুন
‘ওস্তাদ ভাই লাঠিখেলা উৎসব ও লোকজ মেলা’র উদ্বোধনী দিনে বিভিন্ন স্থান থেকে লাঠিয়ালেরা অংশ নিয়েছেন। বৃহস্পতিবার বিকেলে কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ মাঠে
ছবি: প্রথম আলো

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অধ্যক্ষ শিশির কুমার রায় বলেন, ‘এই শিকড় (লাঠিখেলা) ধরে রাখতে হবে, হারানো যাবে না, ভুলে যাওয়া যাবে না। নারী-পুরুষ সবারই লাঠির কসরত জেনে রাখা ভালো। একদিকে যেমন খেলা দেখানো যায়, আরেক দিকে এই কসরতের মাধ্যমে আত্মরক্ষার কৌশলও রপ্ত করা থাকে, যা বিপদে কাজে লাগানো যেতে পারে।’

উৎসব উপলক্ষে কলেজ মাঠ সাজানো হয়েছে। গতকাল সকালে শতাধিক লাঠিয়াল বাহারি পোশাক পরে লাঠি হাতে শোভাযাত্রা বের করেন। শোভাযাত্রাটি কুষ্টিয়া শহর প্রদক্ষিণ করে আবার কলেজ মাঠে ফিরে আসে। সেখানে হাজারো দর্শক লাঠিখেলা দেখতে ভিড় করেন। কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে লাঠিয়াল দল এসেছে। একেক দলে ২০ জনের বেশি সদস্য।

আরও পড়ুন
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে লাঠিয়াল বাহিনীর সদস্যেরা। বৃহস্পতিবার বিকেলে কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ মাঠে
ছবি: প্রথম আলো

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৩৩ সালে কুষ্টিয়া শহরের মজমপুর এলাকায় প্রয়াত সিরাজুল হক চৌধুরী লাঠিখেলার দল তৈরি করেছিলেন। এরপর তাঁর পরিবারের সদস্যেরাও লাঠিখেলায় জড়িয়ে পড়েন। নারী-পুরুষ সবাই লাঠিখেলার দলে নাম লেখান। ৯১ বছর ধরে চৌধুরী পরিবারের শতাধিক নারী-পুরুষ গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী লাঠিখেলা ধরে রেখেছেন।

কুষ্টিয়ায় অবস্থিত বাংলাদেশ লাঠিয়াল বাহিনীর কেন্দ্রীয় সদর দপ্তরের সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের দিনও লাখো মানুষ সমবেত হয়েছিলেন বাংলার এই বাঁশের লাঠি হাতে নিয়ে। ১৯৯৩ সালে সাফ গেমসের সমাপনীতে লাঠিয়াল বাহিনীর শতাধিক সদস্য লাঠিখেলা প্রদর্শন করেছিলেন। এমনকি দেশের বাইরে কলকাতাতেও এই লাঠিলেখা দেখানো হয়েছিল। এই খেলা অব্যহত রাখা হবে।

লাঠি খেলার কসরতে ছোট ছেলেরা
ছবি: প্রথম আলো

চৌধুরী পরিবারে সন্তান মনজুরীন সাবরিন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর দাদার হাতে তৈরি লাঠিয়াল বাহিনী। তিনিও দেশের বিভিন্ন জায়গায় লাঠিখেলা দেখান। নারীরাও যাতে এই খেলা রপ্ত করতে পারেন, সেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আত্মরক্ষায় নারীরা যাতে কাজে লাগাতে পারেন, এ জন্য দেশের স্কুল-কলেজে লাঠিখেলার কসরত শেখানো দরকার। উদ্বোধনী দিনে তিনিও লাঠিখেলা দেখান।

যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে এসে উৎসবে যোগ দিয়েছেন জিয়া হাসান চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘দাদার হাতে তৈরি সংগঠন ৯০ বছর পেরিয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছা আছে শত বছর পার করা হবে। আমি আমেরিকায় লাঠিখেলা প্রদর্শন করেছি। কানাডা, লন্ডনেও প্রদর্শন করা হয়েছে। তারা অবাক হয়। খুবই আগ্রহের সঙ্গে এই খেলা বরণ করে তারা।’

উৎসবে আসা লাঠিয়াল বাহিনীর সদস্যেরা লাঠি ছাড়াও ঢোল, কাসরসহ বিভিন্ন ধরনের বাদ্যযন্ত্র নিয়ে এসেছেন। কারও হাতে মোটা লাঠি আবার কারও হাতে চিকন ছড়ি। মাথায় বাঁধা কাপড়। ঢোল আর কাসরের তালে তালে নেচে প্রদর্শন করা হয়ে লাঠিখেলা।

লাঠি খেলার কসরতে মেয়েরাও অংশ নিয়েছে
ছবি: প্রথম আলো

আজিজল বিশ্বাস বলেন, যৌবনকালে একটানা এক থেকে দেড় ঘণ্টা লাঠি হাতে কসরত দেখাতে পারতেন। এখন ১০ মিনিটের বেশি পারেন না। ঢোলে লাঠির বাড়ি পড়লে শরীর এমনিতেই নেচে ওঠে। আর মন তো খেলতে চায় লাঠিখেলা।
ছোট্ট লাঠিয়াল ইমরান হোসেন জানায়, দুই বছর ধরে লাঠিখেলার কসরত শিখছে সে। পড়াশোনাও করে। তারা চাচা হলেন ওস্তাদ। তার পরিবারের আরও সদস্য এই খেলার সঙ্গে জড়িত।

উৎসব উদ্‌যাপন কমিটি আহ্বায়ক সাইফুল আলম চৌধুরী বলেন, উৎসবের মূল উদ্দেশ্য হলো লাঠিখেলার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের চিত্তকে প্রফুল্ল রাখা। পাশাপাশি বিভিন্ন অঞ্চলে লাঠিয়ালদের মধ্যে সেতুবন্ধ তৈরি করা। প্রতিদিন বিকেল থেকে রাত আটটা পর্যন্ত উৎসব চলবে। আগামীকাল শনিবার রাত আটটায় উৎসবের সমাপনী হবে।