পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন পাওয়ার আগেই পাহাড় কাটল চমেক কর্তৃপক্ষ

চট্টগ্রাম নগরের চট্টেশ্বরী মোড় এলাকায় গোয়াছি বাগান এলাকার এই পাহাড়টির বড় অংশ কেটে ফেলা হয়েছে। গতকাল দুপুরেছবি: সৌরভ দাশ

১৫০ শয্যার বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি হাসপাতাল নির্মাণের জন্য পাহাড় কাটার অনুমোদন চেয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরে আগেই আবেদন করেছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এখনো অনুমতি মেলেনি। কিন্তু তার আগেই নগরের চট্টেশ্বরী সড়কের গোয়াছিবাগানের মেডিকেল ছাত্রাবাসসংলগ্ন পাহাড়ে এক্সকাভেটরের ফলার কোপ পড়েছে। বিশাল পাহাড়ের একটা অংশ ঢালু আকারে কেটে ফেলা হয়েছে।

তবে চমেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবি, পাহাড়ধস থেকে নির্মীয়মাণ বার্ন হাসপাতাল ভবন রক্ষার জন্যই চীনা প্রযুক্তিতে পাহাড়কে ‘স্লোপ’ বা ঢালু করা হচ্ছে। এখানে পাহাড় কাটা হচ্ছে না। পাহাড় ড্রেজিং করা হচ্ছে। এ জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরে কয়েক দিনের মধ্যে পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন (এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট-ইআইএ) জমা দেওয়া হবে বলে চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ তসলিম উদ্দীন জানান।

চীনের আর্থিক সহায়তায় চমেক হাসপাতাল ক্যাম্পাসে ১৫০ শয্যার বার্ন হাসপাতালটি হচ্ছে। গত বছরের ৯ মে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (একনেক) সভায় ২৮৫ কোটি টাকার প্রকল্পটির অনুমোদন হয়। হাসপাতালটির নির্মাণকাজ ও যন্ত্রপাতি চীনের অর্থায়নে হবে। বাংলাদেশ সরকার ১০৫ কোটি টাকা দেবে।

এখন ছয়তলা ভবন নির্মাণের প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছে। এর অংশ হিসেবে সেখানে থাকা গাছপালা ও পাহাড় কাটা হচ্ছে। এ জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরে গত বছর একটা আবেদন করেছে চমেক কর্তৃপক্ষ। কিন্তু তার এখনো চূড়ান্ত অনুমোদন মেলেনি। এখনো ইআইএ জমা দেওয়া হয়নি। সাধারণত ইআইএ অনুমোদনের পর পাহাড় ও গাছপালা কাটা হয়। কিন্তু এখানে অন্তত চার মাস ধরে এই কাজ চলছে বলে স্থানীয় মানুষের অভিযোগ।

সরেজমিনে দেখা গেছে, গোয়াছিবাগান এলাকায় রাস্তার পাশে ঘেরাও করে রাখা হয়েছে পুরো প্রকল্প এলাকা। বাইরে থেকে পাহাড়ের ওপর রাখা একটি এক্সকাভেটর ও কাটা পাহাড় দেখা যাচ্ছে। ফটক দিয়ে ভেতরে ঢোকার পর কর্তব্যরত দারোয়ান কাটা পাহাড়ের ছবি তুলতে বাধা দেন। পুরো এলাকা সিসি ক্যামেরা নিয়ন্ত্রিত বলে সাইনবোর্ড দেওয়া হয়। দেখা যায়, দুটি এক্সকাভেটর দিয়ে পাহাড় কাটা চলছে। ইতিমধ্যে পাহাড়ের একটা অংশ কেটে ফেলা হয়েছে।

জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক সোনিয়া সুলতানা বলেন, ‘পাহাড় কাটার জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরে আবেদন করেছিল আগেই। এখনো অনুমোদন দেওয়া হয়নি। তারা ইআইএ জমা দেয়নি এখনো। তবে টার্মস অব রেফারেন্স এসেছে। পাহাড় কাটার অভিযোগ পাওয়ার পর আমাদের একটা দল সেখানে পাঠিয়েছি।’

গতকাল রোববার পরিবেশ অধিদপ্তরের একটা দল গোয়াছিবাগান এলাকার প্রকল্প এলাকা পরিদর্শনে যায়। ওই পরিদর্শন দলের সঙ্গে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) সমন্বয়ক মনিরা পারভীনও ছিলেন। এর আগে বেলার সঙ্গে গত বছর চমেক হাসপাতালের তৎকালীন পরিচালক একটা সভা করেছিলেন। ওই সভায় পাহাড় কাটা হবে না বলে নিশ্চিত করা হয়েছিল।

মনিরা পারভীন প্রথম আলোকে বলেন, এখনই যে পরিমাণ পাহাড় কেটে ফেলা হয়েছে, তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। টিনের ঘেরাও দিয়ে পাহাড় কাটা হচ্ছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আগে বলেছিল, পাহাড় কাটা হবে না। এখন তারা শর্ত মানেনি।

পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে ১৩ জানুয়ারি শুনানির নোটিশ দেওয়া হয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষককে। অধিদপ্তরের নাম প্রকাশে এক কর্মকর্তা বলেন, যেভাবে পাহাড় কাটা হচ্ছে, তা মানা যায় না। ঢালু করার কথা বলা হলেও মূলত পাহাড়ের বিশাল অংশ এখন মাটিতে মিশে গেছে।

অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ তসলিম উদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘পাহাড় কাটা হচ্ছে না। পাহাড়টাকে ঢালু করা হচ্ছে, যাতে ভূমিধস না হয়। ভবন সমতলে হবে। পাহাড় রক্ষার জন্য প্রতিরোধদেয়াল নির্মাণ করা হবে। পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে আমরা টার্মস অব রেফারেন্স পেয়েছি। ইআইএ এখনো দেওয়া হয়নি। কয়েক দিনের মধ্যে এটা দেব। বিষয়টি নিয়ে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা ও পরিবেশ উপদেষ্টা—দুজনের সঙ্গেই আলাপ হয়েছে।’

মোহাম্মদ তসলিম উদ্দীন আরও বলেন, ‘পাহাড়ের ক্ষতি করা হবে না। যে প্রযুক্তি এখানে ব্যবহার করা হচ্ছে, তা আগে হয়নি। পাহাড়টি ঢালু থাকবে। চীনা প্রকৌশলীদের নকশা অনুযায়ী কাজ হচ্ছে। যদি এটা নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণা হয়, তখন বিশাল এই বিদেশি সহায়তা তা হুমকিতে পড়বে। তবে নিশ্চিত থাকুন, পরিবেশের ক্ষতি হবে না।’

চট্টগ্রামে যত পাহাড় কাটা

‘হিল কাটিং ইন অ্যারাউন্ড চিটাগং সিটি’ নামে অধ্যাপক সিরাজুল হকের করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, নগরে ২০০০ সালে পাহাড় কাটা হয় ৬৭৯ হেক্টর এলাকায়। এক যুগ পর তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ২৯৫ হেক্টরে। পাহাড় কাটার সঙ্গে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী রাজনীতিক, পুলিশ, সরকারি –বেসরকারি কর্মকর্তাসহ প্রভাবশালীরা জড়িত। বারবার মামলা করেও তাঁদের থামানো যাচ্ছে না।

বেশি পাহাড় কাটা যেখানে

২০১২ সালে প্রকাশিত সিরাজুল হকের গবেষণা অনুযায়ী, ১৯৭৬ সালে নগরের পাঁচ থানা এলাকায় মোট পাহাড় ছিল ৩২ দশমিক ৩৭ বর্গকিলোমিটার। ২০০৮ সালে তা কমে হয় ১৪ দশমিক ২ বর্গকিলোমিটার। নগরের বায়েজিদ ও পাহাড়তলী এলাকায় সবচেয়ে বেশি পাহাড় কাটা পড়েছে। ওই সময়ে বায়েজিদে ৫ বর্গকিলোমিটার ও পাহাড়তলীতে (বর্তমানে ভাগ হয়ে আকবরশাহ থানা) ৪ বর্গকিলোমিটার পাহাড় কাটা হয়।

এখনো আকবরশাহ ও বায়েজিদ—এসব এলাকায় পাহাড় কাটা চলছে। আকবরশাহ এলাকায় এখন পাহাড় কাটার মূল হোতা আওয়ামী লীগ নেতা ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর জহুরুল হক ওরফে জসিম। পাহাড় কাটার অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে একাধিক মামলাও রয়েছে।

এ ছাড়া বায়েজিদ থানা এলাকার রউফাবাদ, অক্সিজেন, ষোলশহর, আরেফিননগর, নাসিরাবাদ, পলিটেকনিক, কূলগাঁও ও জালালাবাদ এলাকায় পাহাড় কাটা চলছে।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) চট্টগ্রাম বিভাগের পাঁচটি জেলা যথাক্রমে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনসহ চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে পাহাড় কাটা বন্ধে ২০১১ সালে একটি জনস্বার্থমূলক মামলা করে। ২০১২ সালের ১৯ মার্চ আদালত এসব জেলার পাহাড় কাটা বন্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন।

বেলার দায়ের করা অপর একটি জনস্বার্থমূলক মামলায় আদালত চট্টগ্রাম নগরের আকবর শাহ থানার অধীন উত্তর পাহাড়তলী মৌজার ১৭৮, ১৭৯ ও ১৮০ নম্বর বিএস দাগে অবস্থিত পাহাড় কাটার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেন।

চমেক হাসপাতালের আগে বায়েজিদ সংযোগ সড়ক তৈরির সময় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) ১৬টি পাহাড় কেটে ফেলেছিল। এ জন্য পরিবেশ অধিদপ্তর সিডিএকে ১০ কোটি টাকা জরিমানা করেছিল। কিন্তু এখনো সেই জরিমানা পরিশোধ করা হয়নি। এ নিয়ে চিঠি–চালাচালি চলছে।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বনবিদ্যা ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মো. কামাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারি–বেসরকারি সব কর্তৃপক্ষ যদি পাহাড় কাটে, আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কী রেখে যাব! জনগোষ্ঠীর জন্য হাসপাতাল যেমন দরকার, তেমনি পরিবেশও দরকার। পাহাড়কে নষ্ট না করেও উন্নয়ন করা যায়, যেটা উন্নত দেশে হয়। পাহাড় কাটা রোধে বারবার আমরা বলে আসছি। কিন্তু তা কেউ শুনছে না। এখন দুর্বার আন্দোলনের পাশাপাশি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দরকার বলে আমি মনে করি।’