নদীর তলদেশে ৪ মিনিটের সফর

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলে ঢোকার পথছবি: সৌরভ দাশ

বসন্তের পড়ন্ত বিকেল। সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। রোদের তেজও কমে এসেছে। পাশের সমুদ্র থেকে বয়ে আসছে মৃদুমন্দ হাওয়া। এমন পরিবেশে টানেল পাড়ি দেওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন আরিফুর রহমান। গত বছরের অক্টোবরে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত দেশের প্রথম সুড়ঙ্গপথে (টানেল) গাড়ি চলাচল শুরু হয়। তখন থেকই টানেল দেখার খুব ইচ্ছা ছিল চাকরিজীবী আরিফুরের। কিন্তু নানা ব্যস্ততায় তা আর হয়ে ওঠেনি।
গত বৃহস্পতিবার অফিসের কাজের চাপ ছিল কম। তাই একটু আগেভাগে বের হয়ে যান। বিকেলেই চলে যান চট্টগ্রাম নগরের পতেঙ্গার গোলচত্বরে। যেখান থেকে শুরু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল। টানেলের ভেতর দিয়ে মোটরসাইকেল ও তিন চাকার যান চলাচল নিষিদ্ধ। আবার ব্যক্তিগত গাড়িও নেই তাঁর। তবে এই সমস্যার সমাধান আছে। টানেলের গোলচত্বরে যাত্রীদের অপেক্ষায় ছিল সারি সারি বাস। যাত্রী পূর্ণ হলেই ছাড়ে এসব গাড়ি। এর একটিতে উঠে পড়েন আরিফুর। নদীর তলে সুড়ঙ্গপথ নিয়ে বেশ উত্তেজনাবোধ করছিলেন তিনি।

বাসের সব আসন পূর্ণ হতে বেশি সময় লাগল না। ঠিক সোয়া চারটায় গাড়ি পতেঙ্গা থেকে ছাড়ে। বাসটি মুহূর্তের মধ্যে গোলচত্বর থেকে টানেলে ঢুকে পড়ে। টানেলের ভেতরের চিত্র কেমন হবে, সেখানে কী থাকবে, তা নিয়ে আগ্রহের শেষ ছিল না আরিফুরের। বাস টানেলে ঢুকতেই পকেট থেকে দ্রুত মুঠোফোন বের করেন। চালু করেন ক্যামেরা। করতে থাকেন একের পর এক ভিডিও।
কৃত্রিম আলোয় আলোকিত টানেলটি। ছয় ধরনের আবহাওয়া পরিস্থিতি মাথায় রেখে আলোকায়ন করা হয়েছে সরু পথজুড়ে। সানি ডে বা রৌদ্রোজ্জ্বল, রেইনি ডে বা বৃষ্টির দিন, ওভারকাস্ট ডে বা মেঘলা দিন, হেভি ওভার কাস্ট ডে বা বেশি মেঘলা দিন, সন্ধ্যার সময়, রাতের বেলা। টানেলে ঢুকতে ও বের হতে গিয়ে দিনের স্বাভাবিক আলোয় কোনো সমস্যা যেন না হয়, সে ব্যবস্থাও করা হয়েছে। টানেলের টিউবের দুই পাশে ডেকোরেটিভ বোর্ড দিয়ে সাজানো। রয়েছে জরুরি বহির্গমনের পথ। আরিফুর মুঠোফোনে ক্যামেরাবন্দী করে রাখছিলেন মুহূর্তগুলো।

নদীর তলদেশে তিন কিলোমিটারের বেশি সুড়ঙ্গপথ
ছবি: প্রথম আলো

টানেলের ভেতরে সৌন্দর্য দেখায় এমন মগ্ন ছিলেন আরিফুর, কখন যে নদী পার হয়ে এসেছেন খেয়াল করেননি। মাত্র ৪ মিনিট সময় লাগল পথটা পাড়ি দিতে। আর নগরের পতেঙ্গা থেকে টানেল পার হয়ে সংযোগ সড়ক দিয়ে আনোয়ারা চৌমুহনী পৌঁছাতে সময় লাগল মাত্র ১০ মিনিট। টোল দেওয়া ছাড়া এই ৯ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে কোথাও থামতে হয়নি।
আরিফুর রহমানের মতো এভাবে প্রতিদিন অনেকেই টানেল দেখতে ছুটে আসেন। আবার জরুরি প্রয়োজনে টানেল ব্যবহারকারীর সংখ্যাও কম নয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল চট্টগ্রাম নগরের সঙ্গে নদীর দক্ষিণ প্রান্তের মানুষের যাতায়াত অনেকটাই সহজ করে দিয়েছে। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা যানবাহন এখন চট্টগ্রাম নগরে প্রবেশ না করে টানেল দিয়ে কক্সবাজার, বান্দরবানসহ কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছে যেতে পারছে। টানেলটি হওয়ার পর পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতেও পর্যটকের ভিড় বেড়েছে। টানেল দেখতে আসা লোকজন এখন পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতও ঘুরে যান।
এই পথের কারণে নদীর নগর ও গ্রাম প্রান্ত আগের চেয়ে অনেক বেশি জমজমাট। পাল্টে গেছে অবকাঠামোগত চেহারাও। একসময়ের অবহেলিত জনপদে লেগেছে উন্নয়নের ছোঁয়া।

কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত মূল সুড়ঙ্গপথের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার। দেশের প্রথম নদীর তলদেশের সুড়ঙ্গপথ এটি। এটি নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।
এই টানেলে দুটি টিউব বা সুড়ঙ্গ রয়েছে। একটি পথ গেছে নগরের পতেঙ্গা থেকে আনোয়ারা প্রান্তে। আরেকটি এসেছে আনোয়ারা থেকে পতেঙ্গা প্রান্তে। প্রতিটি টিউবের দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার। প্রতিটি প্রস্থে ৩৫ ফুট করে এবং উচ্চতা ১৬ ফুট। প্রতি টিউবে দুটি করে লেন রয়েছে। আর টিউবগুলো অবস্থিত কর্ণফুলী নদীর তলদেশের ১৮ থেকে ৩১ মিটার গভীরে (সর্বোচ্চ গভীরতা ১০১ ফুট)। টিউবগুলো একটি থেকে আরেকটির দূরত্ব ১২ মিটার।

ছয় ধরনের আবহাওয়া পরিস্থিতি মাথায় রেখে আলোকায়ন করা হয়েছে সরু পথজুড়ে
ছবি: প্রথম আলো

চাকরিজীবী আরিফুর রহমান দেশের প্রথম টানেল দেখতে এসেছিলেন কৌতূহল থেকে। তবে মোহাম্মদ ওমর ফারুকদের জন্য টানেল যেন আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ প্রান্তের উপজেলা আনোয়ারায় গ্রামের বাড়ি তাঁর। জীবিকার তাগিদে পরিবার নিয়ে থাকেন চট্টগ্রাম শহরের স্টিলমিল বাজার এলাকায়। এই বাজারে রয়েছে তাঁর দোকান। কিন্তু পারিবারিক নানা কাজে যেতে হয় গ্রামের বাড়িতে।
একসময় কর্ণফুলী নদী পার হওয়া ভীষণ ঝক্কিঝামেলার ব্যাপার ছিল ওমর ফারুকের কাছে। নদীর ঘাটে এসে নৌকার জন্য দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হতো। ছিল নৌকাডুবির ঝুঁকি। দুর্ঘটনার আতঙ্ক নিয়ে ছয় মাস আগেও নদী পার হতেন। এখন এসবের কিছু নেই। মাত্র ৫০ টাকা হলেই বাসে করে টানেল পাড়ি দেওয়া যায়।
বাসে করে সুড়ঙ্গপথ পার হওয়ার সময় গত বৃহস্পতিবার মোহাম্মদ ওমর ফারুক বলেন, শীতের মৌসুমে কোনো রকম পার হওয়া গেলেও বর্ষার সময় নদী ভয়াল রূপ ধারণ করত। তখন নৌকা দিয়ে পার হওয়া মানে জীবন হাতে নিয়ে পার হওয়া। আবার নদীপথে না গেলে সড়কপথে অনেক দূর ঘুরে আসতে হতো। এখন নদীর নিচে টানেল হয়েছে, সেসব বিপদ কেটে গেছে। আগে যেখানে বাড়ি যেতে এক–দেড় ঘণ্টা লেগে যেতে, এখন সেখানে আট–দশ মিনিট সময় লাগে।