ব্যবসায়ীদের স্বার্থে মানদণ্ড স্থগিত, দেশে ঢুকছে ‘খাবারের অযোগ্য’ গুড়
নিম্নমানের গুড় আমদানি রুখতে তিন মাস আগে গুড়ের মানদণ্ড নির্ধারণ করে দেয় বিএসটিআই। এতে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ স্থলবন্দরে আমদানিকারকদের বিপুল পরিমাণ নিম্নমানের গুড় আটকে যায়। পরে ব্যবসায়ীদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঘোষিত মানদণ্ড দুই মাসের জন্য স্থগিত করা হয়। এ সুযোগে গত এক মাসে ১৫১ মেট্রিক টন ‘খাবারের অনুপযোগী’ গুড় দেশে ঢুকেছে।
‘সুগার মলাসেস’ নামে ভারত থেকে এসব গুড় আমদানি করা হয়েছে। এসব গুড়ে সালফার ডাই-অক্সাইডের মাত্রা অনেক বেশি। রংসহ বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার করে আমদানি করা ‘মলাসেস’ দিয়ে আখ ও খেজুরের গুড় বানানো হয়। পরে রাজশাহী-নাটোরের বিভিন্ন এলাকায় মানুষের খাবারের গুড় হিসেবে বিক্রি করা হয়।
এর আগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালিয়ে অনেকবার আমদানি করা ‘মলাসেস’ দিয়ে বানানো গুড়ের কারখানা ভেঙে দিয়েছে। কারখানামালিকদের জরিমানা করেছে, গুড় ধ্বংস করেছে। এরপরও এ ব্যবসা বন্ধ থাকে না। ভারত থেকে নিম্নমানের গুড় আমদানিও বন্ধ হয়নি। তবে গত ১৫ জুলাই বিএসটিআই গুড়ের মানদণ্ড ঘোষণার পর দুই মাস আমদানি বন্ধ ছিল।
বিএসটিআই সূত্রে জানা গেছে, গুড়ের যে মানদণ্ড নির্ধারণ করা হয়েছে, তাতে সালফার ডাই-অক্সাইডের সর্বোচ্চ মাত্রা রাখা হয়েছে ৭০ পিপিএম। আন্তর্জাতিক গুড়ের মানেও সেই মাত্রা ৭০। এ ছাড়া মানদণ্ডে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের (বিএফএসএ) মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে ও নিরাপদ খাদ্য (দূষণকারী জীবাণু নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ) প্রবিধানমালা ২০২১ অনুযায়ী তিনটি মাইক্রো বায়োলজিক্যাল প্যারামিটার যুক্ত করা হয়েছে। যেগুলো গুড়ে থাকলে খুবই অস্বাস্থ্যকর হিসেবে নির্দেশ করে। কিন্তু আমদানিকারকেরা ভারত থেকে যে গুড় আমদানি করেন, তাতে সালফার ডাই–অক্সাইডের মাত্রা অনেক বেশি। এ ছাড়া ওই প্যারামিটারগুলোরও উপস্থিতি আছে।
সোনামসজিদ স্থলবন্দর সূত্রে জানা গেছে, মানদণ্ড নির্ধারণের পর থেকে ভারত থেকে গুড় আমদানি করতে হলে বিএসটিআইয়ে পরীক্ষণের মাধ্যমে ব্যবসায়ীদের ছাড়পত্র নিতে হয়। কিন্তু মানদণ্ড ঘোষণার পর ছাড়পত্র না পেয়ে ‘চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ আমদানি ও রপ্তানিকারক গ্রুপ’ বিএসটিআই বরাবর আবেদন করে ওই মাইক্রো বায়োলজিক্যাল প্যারামিটারগুলো রহিত করার অনুরোধ করেছে। পাশাপাশি সালফার ডাই–অক্সাইডের মাত্রা বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছেন। ব্যবসায়ীদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৭ সেপ্টেম্বর বিএসটিআই নির্ধারিত গুড়ের মান দুই মাসের জন্য স্থগিত করে। এ সুযোগে ‘সুগার মলাসেস’ (সেমি লিকুইড গুড়) নামে গত ২১ সেপ্টেম্বর একটি ট্রাকে ৩১ মেট্রিক টন, ২২ সেপ্টেম্বর তিনটি ট্রাকে ১২০ মেট্রিক টন মানুষের খাবারের অনুপযোগী গুড় সোনামসজিদ স্থলবন্দর দিয়ে দেশে ঢোকে।
গত শনিবার রাজশাহীর বাঘা উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে আমদানি করা ওই গুড় দিয়ে নতুন গুড় তৈরি করতে দেখা যায়। আগে এই গুড় প্রকাশ্যে ভ্যানে বা ট্রাকে বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করা হতো। শনিবার সকালে জেলার দিঘা বাজারের সামনে গুড়সহ কয়েকটি ভ্যানের দেখা পাওয়া যায়। গুড়গুলো কাপড় দিয়ে ঢাকা ছিল। কাপড় সরিয়ে দেখা গেছে, সব টিনজাত ভারতীয় গুড়। উপজেলার খর্দ্দ বাউসা গ্রামের একটি বড় কারখানায় ওই গুড় গলিয়ে নতুন গুড় বানাতে দেখা যায়। আড়ানি বাজারের একটি ভাঙারির দোকানে বিপুল পরিমাণ গুড় পরিবহনের খালি টিনের পাত্র ভাঙতে দেখা যায়। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা খালি পাত্রগুলো ভাঙারির দোকানে বিক্রি করেন।
আমদানিকারকদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গুড়ের মানদণ্ড স্থগিত করা নিয়ে গত ১১ সেপ্টেম্বর একটি সভা করে ‘সুগার অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ প্রোডাক্টস টেকনিক্যাল কমিটি’। সভায় সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি প্রকৌশল ও প্রযুক্তি অনুষদের ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক মো. আনিছুর রহমান মজুমদার। মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, কোনো খাদ্যে সালফার ডাই–অক্সাইডের মাত্রা ৭০ পিপিএমের বেশি হলে এবং মানদণ্ডে উল্লিখিত মাইক্রো বায়োলজিক্যাল প্যারামিটারগুলো থাকলে তা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। প্যারামিটারগুলো নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের প্রবিধানমালায় থাকলেও বিএসটিআইয়ে বাধ্যতামূলক নয়। এ জন্য আমদানিকারকদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঘোষিত মানদণ্ড দুই মাসের জন্য স্থগিত রাখা হয়েছে। এখন ব্যবসায়ীরা নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনার পর বিষয়টির সমাধান করতে পারেন। পরে কমিটি সেই অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেবে।
সভায় উপস্থিত ছিলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি মো. আবদুল ওয়াহেদ। তিনি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় সালফার ডাই–অক্সাইডের মাত্রা বাড়ানো সমীচীন হবে না। তবে প্রান্তিক কৃষক ও আমদানিকারকদের সমস্যা বিবেচনা করে মাইক্রো বায়োলজিক্যাল প্যারামিটারগুলোর পরীক্ষা দুই মাসের জন্য স্থগিত করার সুপারিশ তিনি করেছেন। এ সময়ের মধ্যে ব্যবসায়ীরা রপ্তানিকারক দেশ ও নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি সুরাহা করতে পারেন। তিনি বলেন, ‘ব্যক্তিগতভাবে আমি মানুষের ক্ষতি করে ব্যবসা চলুক, এটা চাই না।’
বিএসটিআইয়ের ঢাকার উপপরিচালক (কৃষি ও খাদ্য) এনামুল হক একই সভায় উপস্থিত ছিলেন। মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গুড়ের গুণগত মানোন্নয়নের জন্য বিডিএস (মানদণ্ড) হালনাগাদ করা হয়। এতে কেউ বিদেশ থেকে গুড় আমদানি করলে তাঁকে শতভাগ মান নিশ্চিত করে আনতে হবে। এতে কেউ গোখাদ্য বা অপজাত মানুষকে খাওয়াতে পারবে না। এতে গুড় ব্যবসায়ীরা বিপাকে পড়েন। বন্দরে তাঁদের গুড় ছাড় করতে পারছেন না। তাঁরা আবেদন করায় দুই মাস সময় দেওয়া হয়েছে। তাঁরা নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে সুপারিশ আনতে পারলে কমিটি সেটা নিয়ে কাজ করবে। তবে তাঁরা গুণগত মানের ব্যাপারে আপস করবেন না।