খুলনায় ঈদের একাল-সেকাল

সবাই মিলে ঈদের জামাতে যাচ্ছেন মুসল্লিরা। খুলনা সার্কিট হাউজ, খুলনা শহর, ১১ এপ্রিলছবি: সাদ্দাম হোসেন

একরাশ আনন্দ আর খুশির আমেজ নিয়ে সারা দেশের মতো খুলনায়ও উদ্‌যাপিত হচ্ছে পবিত্র ঈদুল ফিতর। ধনী-গরিব মিলেমিশে আনন্দ ভাগাভাগি করার এই দিনে সকাল আটটায় সার্কিট হাউস ময়দানে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রতিবারের মতো এবারও প্রধান জামাতে অংশ নিয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। সুবিশাল প্যান্ডেলের নিচে প্রধান জামাতে ঈদের নামাজ আদায়ের জন্য এক সারিতে দাঁড়ান বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, প্রশাসনের কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী-শিল্পপতিসহ নগরের বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা সাধারণ মানুষ। কোলাকুলির মাধ্যমে সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি, ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করেছেন একজন আরেকজনকে।

খুলনা নগরের বিভিন্ন জায়গা বাংলা ও আরবিতে ঈদ মোবারকখচিত ব্যানার দিয়ে সাজানো হয়েছে। শহরের অন্য ঈদগাহগুলোতে জৌলুশ ছিল চোখে পড়ার মতো।
তবে এখন যেভাবে খুলনায় ঈদ উদ্‌যাপন করা হয়, সব সময় এমনটা হতো না। এই উৎসবের ধরন-ধারণ সময়ের সঙ্গে নানাভাবে পরিবর্তিত হয়েছে।

খুলনার প্রবীণ মানুষদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখনকার মতো এতটা বর্ণিল ছিল না আগের সময়ের ঈদ। সেই সময়ে চাকচিক্যের বাহুল্য নয়, সহজ–সাধারণ আনন্দের মধ্যেই ঈদের দিন যাপিত হতো। পাকিস্তান আমলেও ঈদের প্রধান জামাত সার্কিট হাউসেই অনুষ্ঠিত হতো। তখন শহরের লোকজন এতটা বেশি না থাকায় মাঠে এত বেশি জমায়েত না হলেও নেহাত কম হতো না। তবে তখন ঈদের দিন নিয়ে মাঝেমধ্যে একটা সমস্যা দেখা দিত। পশ্চিম পাকিস্তান আর পূর্ব পাকিস্তানে একই দিনে চাঁদ দেখা যেত না, পাকিস্তান সরকার চাইত একই দিনে ঈদ হোক, এটা নিয়ে কয়েক বছর সমস্যা হয়েছিল।

খুলনা সরকারি ব্রজলাল (বিএল) কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ জাফর ইমামের বয়স এখন ৮৩ বছর। জাফর ইমাম স্মৃতি হাতড়ে বললেন, ‘রমজানের ও ঈদের চাঁদ দেখার জন্য ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা ছিল। ঈদের দিন আমরা গোসল করে আতর মেখে সার্কিট হাউস মাঠে যেতাম। পাটকলগুলো থেকে চট এনে বিছিয়ে দেওয়া হতো, তার ওপর যার যার জায়নামাজ পেতে আমরা ঈদের নামাজ পড়তাম। ইমাম সাহেবদের ইসলামি বিষয়ে বয়ানের পাশাপাশি খুলনা পৌরসভার চেয়ারম্যান বক্তব্য দিতেন। রাস্তার দুই পাশে ফকির–মিসকিনদের চাপ থাকত। এখন আনুষ্ঠানিকতা বেড়েছে।’ তিনি বলতে থাকেন, ‘ঈদের দিন আমরা বাড়ি বাড়ি যেতাম, সালাম করতাম, সালামি পেতাম। আসলে ঈদের দিন কাটত বেড়িয়ে বেড়িয়ে। এখনো কিন্তু স্বজনদের সঙ্গে মিলে ঈদ করার প্রবণতাটা আছে।’

ঈদের দিনের পোশাক সম্পর্কে জাফর ইমাম বলেন, পাকিস্তানি আমলে শেরওয়ানিটা ছিল ঈদের পোশাক। ছোটদের পোশাকের আলাদা বৈচিত্র্য তেমন কিছু ছিল না। তবে নতুন পোশাক সবাই পরত। এখনকার মতো নতুন জামাকাপড়, জুতা আর সুস্বাদু খাবারের সমারোহ তখনো ছিল। তবে এখন ঈদের বাহ্যিক চাকচিক্য বেড়েছে বহুগুণ। সময়ের পরিবর্তনে যোগ হয়েছে প্রচুর অনুষঙ্গ। পোশাক, সাজগোজ আর আতিথেয়তায় বদল এসেছে অনেক। বেড়েছে নারী-পুরুষ সবার সক্রিয় অংশগ্রহণ। কেনাকাটার পর্ব শুরু হয়ে যায় রমজান মাসের প্রায় প্রথম থেকেই।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক কোষাধ্যক্ষ ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মোহাম্মদ মাজহারুল হান্নান ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় চার বছর বয়সে পরিবারের সঙ্গে ভারত থেকে খুলনায় আসেন। পাকিস্তান আমল এবং মুক্তিযুদ্ধ–পরবর্তী সময়ের ঈদের স্মৃতি এখনো তাঁর মনে জ্বলজ্বল করছে।

এখনকার সময়ের সঙ্গে ওই সময়ের ঈদের তুলনা টানতে গিয়ে মোহাম্মদ মাজহারুল হান্নান বলেন, তখনো সার্কিট হাউসে ঈদের প্রধান জামাত হতো। তবে তখন এখনকার মতো উপচে পড়া ভিড় হতো না। এখন জমকালো তোরণ, প্যান্ডেল, সিটি করপোরেশনের বড় আয়োজন—এসব আগে ছিল না। তখন নামাজ পড়ত, মানুষ কোলাকুলি ও কুশল বিনিময় করে চলে আসত। এখন তো অনেক কিছু, তবে কিছুটা আর্টিফিশিয়াল হয়ে গেছে।

ওই সময়ের ঈদের দিনের কথা বলতে গিয়ে মাজহারুল হান্নান বলেন, ‘বন্ধুরা দু-তিন আগে বলে রাখতাম, বড় মাঠে (সার্কিট হাউস) নামাজে যেতে হবে। ঈদের নামাজ শেষে ওখান থেকেই আমরা বন্ধুদের বাড়ি যেতাম। এখন পুনর্মিলনী, ঈদ মেলা এটা-ওটা হয়। আগে গ্রামে কিছু কিছু জায়গায় ঈদ উপলক্ষে মেলা হতো। শহরে মেলা দেখিনি।’

ঈদের দিনের ঘোরাঘুরি সম্পর্কে মাজহারুল হান্নান বলেন, ‘বেড়ানো আর খাওয়াদাওয়াই ছিল ঈদের সবকিছু। ছোটরা বন্ধুর বাড়ি আর বড়রা আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে বেশি যেত। কিছু কিছু বাছাই করা আত্মীয়ের বাসায় আমরা ছোটরা যেতাম। সালাম করলে দু-চার আনা সালামি পাওয়া যেত। তাতে খুব খুশি হতাম। কোনো কোনো ঈদে আমরা জেলখানা ঘাটের খেয়া পার হয়ে সেনের বাজারের দিকে যেতাম। নদীর ওপারে যাওয়া ছিল রোমাঞ্চকর। আর সামাজিক বন্ধন বেশি থাকায় বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ানোটা বেশি ছিল। ঈদের দিন মানুষ পার্কে সময় কাটাতে তেমন যেত না।’ এর সঙ্গে তিনি যোগ করেন, তখন ঈদের দিনের অন্যতম অনুষঙ্গ ছিল হলে সিনেমা দেখা। হলে কলকাতা এবং পাকিস্তানের সিনেমা মুক্তি পেত। হলের সামনে লম্বা লাইন পড়ত। টিকিট পাওয়া ভীষণ কষ্টসাধ্য ছিল। টিকিট কালোবাজারিও হতো। একটা শ্রেণির লোক ছিল, যাদের কাছে ঈদের দিন সিনেমা না দেখতে পারলে ঈদটা বৃথা গেল অনুভূতি হতো।

আলাপে আলাপে মাজহারুল হান্নান বলেন, এখন পয়সার আধিক্য হয়েছে। জৌলুশ বেড়েছে অনেক। তখন অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এত ছিল না। প্রতি ঘর কমবেশি একরকম ছিল। সমাজব্যবস্থাটা অভিভাবকনির্ভর ছিল। অভিভাবকেরা যেটা দিতেন, তা–ই পরতে হতো। আবদার করার খুব বেশি সুযোগ ছিল না। তবে জুতা-স্যান্ডেল সব ঈদে না পাওয়া গেলেও নতুন পোশাক পাওয়া যেত। তৈরি পোশাকের (রেডিমেট) তখন আধিপত্য ছিল না। মাপ দিতে যেত হতো দরজির কাছে। শেরওয়ানির চল ছিল, তবে সাদা পাঞ্জাবিও অনেকে পরতেন।

খুলনার প্রবীণ প্রজন্মের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঈদের দিন নারীরা তেমন বের হতেন না। কিশোরীরা অনেকে অভিভাবকের সঙ্গে, কখনো কয়েকজন বান্ধবী মিলে আশপাশের বাড়িতে যেত; তবে তা ছিল হাতে গোনা। তখন ঈদের দিন খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা সব বাড়িতেই হতো। মেহমান আসছে-যাচ্ছে। ঈদের দিন হেঁশেল সামলেই দিন পার হতো নারীদের।