মেঘনায় ৬ ঘণ্টায় সুলতান মাঝির জালে ৩ ইলিশ

রাতভর মাছ ধরা শেষে নদীর ওপর নৌকা ভাসিয়ে রান্না করছিলেন জেলে সুলতান মাঝি। পঞ্চাশোর্ধ্ব এই জেলের মন ভালো না। রাতভর জাল টেনে মাছের দেখা মিলছে তিনটি। গতকাল মঙ্গলবার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে মেঘনা নদীতে মাছ ধরতে যান তিনি। সঙ্গে তাঁর সহযোগী আরও ১২ জন জেলে ছিলেন। তাঁদের সবার বাড়ি লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার চরবংশী গ্রামে। রাতভর মেঘনার হাইমচর এলাকায় দুবার জাল ফেলেন। প্রায় ছয় ঘণ্টা পর আজ বুধবার সকাল ছয়টা পর্যন্ত ছোট ছোট ইলিশ পেয়েছেন তিনটি।

জেলে সুলতান মাঝি বলেন, জেলেদের খরচ বাদে ইঞ্জিনচালিত নৌকার জ্বালানিসহ সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা খরচ হয়। কিন্তু তিনটি ইলিশ বিক্রি হয় এক হাজার টাকায়। খরচের সাড়ে চার হাজার টাকাই ওঠেনি। রাতভর ১২ জন জেলে নদীতে মাছ ধরেন। সকালে মাছ বিক্রির পর খরচের সব টাকা বাদ দেন। বাকি টাকার অর্ধেক পান নৌকা ও জালের মালিক। আর অর্ধেক টাকা পান সব জেলে।

সুলতান মাঝির দলেরই যে এ অবস্থা, তা নয়, সব জেলেরই একই অবস্থা। নদী থেকে অনেকটা শূন্য হাতে ফিরছেন জেলেরা। আষাঢ়ের শেষেও বাজারে ইলিশের আকাল চলছে। কোথাও কাঙ্ক্ষিত ইলিশ পাচ্ছেন না জেলেরা। মাছঘাটগুলো ফাঁকা পড়ে আছে। যাওবা কিছু ইলিশ নিয়ে জেলেরা ঘাটে ভিড়ছেন, তার দাম আকাশছোঁয়া। সরেজমিন আজ সকালে রায়পুরের হাজিমারা মাছঘাটে ঘুরে জেলে ও মাছ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্যই পাওয়া গেল।

৩৩ বছর ধরে ইলিশ নিয়ে গবেষণা করেছেন বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট নদী কেন্দ্র চাঁদপুরের সাবেক মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আনিসুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নদীদূষণের কারণে গতিপথ পাল্টাচ্ছে ইলিশ। তা ছাড়া ইলিশ ধ্বংসের মূল কারণ কারেন্ট জাল, প্রজনন ও বেড়ে ওঠার সময় ইলিশ ধরা। সেই সঙ্গে অপরিকল্পিতভাবে সারা বছর নদীতে ড্রেজার দিয়ে বালু তোলা, ডুবচর, নাব্যতা ঠিক না রাখাসহ নানা কারণে ইলিশ ধ্বংস হচ্ছে। তবে জুলাই মাসের শেষের দিকে মাছ ধরতে নামলে জেলেদের জালে কাঙ্ক্ষিত ইলিশের দেখা মিলবে বলে আশা তাঁর।

মাছ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিবছর আষাঢ়-শ্রবণ মাসে লক্ষ্মীপুরের মেঘনায় জেলেদের মাছ শিকারের উৎসব শুরু হয়। শত শত নৌকায় হাজার হাজার জেলে ছোটেন মেঘনায়। ইলিশসহ অন্য মাছ ধরতে জেলেরা ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ঘাটে বেড়ে যায় ক্রেতা-বিক্রেতার সমাগম। কিন্তু এবারের চিত্র উল্টো। মাছের দেখা নেই।

চাঁদপুরের ষাটনল থেকে লক্ষ্মীপুরের আলেকজান্ডার পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার নদী এলাকাকে ইলিশের অভয়াশ্রম ঘোষণা করে সরকার। এ জন্য ওই এলাকায় সব ধরনের জাল ফেলা নিষিদ্ধ করে সরকার। জাটকা নিধন বন্ধে মেঘনা নদীতে মার্চ-এপ্রিল দুই মাস সব ধরনের মাছ ধরা নিষিদ্ধ ছিল। নিষেধাজ্ঞা শেষে আবার মেঘনা নদীতে ইলিশ ধরতে নামেন জেলেরা। কিন্তু নদীতে নামার পর কাঙ্ক্ষিত মাছ না পেয়ে হতাশ তাঁরা।

জেলা মৎস্য কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জেলা সদর, রায়পুর, কমলনগর ও রামগতি উপজেলার প্রায় ৬০ হাজার জেলে মেঘনায় মাছ ধরায় নিয়োজিত। তাঁদের মধ্যে নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ৪৬ হাজার ৬৫।

সদর উপজেলার চররমণী গ্রামের জেলে নজরুল ইসলাম বলেন, ‘এবার ইলিশ একেবারেই কম। জালে তেমন ইলিশ মিলছে না। রাত থেকে ভোর পর্যন্ত জাল ফেলে দু–এক হাজার টাকার বেশি ইলিশ উঠছে না জালে। এতে তাদের লাভের চেয়ে লোকসান গুনতে হচ্ছে বেশি। তবু আমরা আশা করছি, পরে যদি কিছু ইলিশ পাওয়া যায়।’

হাজীমারা মাছঘাটের মাছ ব্যবসায়ী আবদুল রাজ্জাক বলেন, ‘মাছঘাটে ভোর থেকে বসে আছি ইলিশের আশায়। কিন্তু দু-চারটে ইলিশের বেশি মাছ নিয়ে কোনো জেলেই আসছে না।’ তাঁর মতো অন্য আড়তদারদেরও ইলিশ না পেয়ে যাঁর যাঁর প্রতিষ্ঠানে বসে থাকতে দেখা যায়।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আমিনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বিগত বছর মাছের ঘাটগুলো থেকে এ সময়ে প্রতিদিন অনেক ইলিশ দেশের বিভিন্ন বাজারে পাঠানো হতো। কিন্তু এবার তুলনামূলক কম মাছ পাওয়া যাচ্ছে। তবে নদীতে পানি বাড়লে ও ভারী বৃষ্টি হলে ইলিশ বেশি ধরা পড়বে বলে মনে করেন তিনি।