এই পথের দুই পাশে শুয়ে থাকে শান্ত-সবুজ নির্জনতা
পথটা এমন যে তার দুই পাশে শুয়ে থাকে শান্ত-সবুজ নির্জনতা। দিন–রাতের দীর্ঘ সময়জুড়ে অনেকটা ঘুমিয়ে কাটায় এই পথ। কোথাও ছলকে পড়ছে রোদ, কোথাও গাছের ছায়ার নিচে সাদা মুদ্রার মতো কাঁপছে রোদের ছোট ছোট ফোঁটা। যাঁরা পথ হেঁটে হৃদয়ে শান্তি অনুভব করতে চান, এই পথ হয়তো তাঁদের নিঃশব্দ-নীরবে ডাকে। মৌলভীবাজারের মুন্সিবাজার-ভৈরববাজার সড়কটি অনেকটা এ রকমই। চা-বাগানের বুক ভেদ করে শান্ত নদীর মতো চলে গেছে এই পথ।
মৌলভীবাজার-ঢাকা আঞ্চলিক মহাসড়কের শ্রীমঙ্গল উপজেলার ভৈরববাজার থেকে (আঞ্চলিক মহাসড়কের মৌলভীবাজার-শ্রীমঙ্গল অংশে) পূর্বদিকে একটি সড়ক গেছে। সেই সড়কে তখন দিনশেষের আলো। এখানে-ওখানে সেই শেষবেলার রঙের ছোপ, শুধু সন্ধ্যার মুহূর্তটিতেই অমন দেখা যায়। সমস্ত দিনের কাজ শেষে একদল নারী-পুরুষ, যাঁদের বেশির ভাগই চা-শ্রমিক জনগোষ্ঠীর। তাঁরা ভৈরববাজারের দিকে হেঁটে চলছেন। ওই বাজারে কেনাকাটা সেরে কেউ সন্ধ্যার পর, কেউ হয়তো আরেকটু রাতে ঘরে ফিরবেন।
সম্প্রতি এক বিকেলে পথটির আরেকটু সামনে গেলে শীতল নির্জনতা নামে। ততক্ষণে মানুষের উপস্থিতি অনেক কমে গেছে। মাঝেমধ্যে শুধু দেখা যায়, এক-দুজন লোক চা-বাগানের কাজ সেরে লাইনের (থাকার বসতির জায়গা) দিকে হেঁটে চলছেন। ভারী, ক্লান্ত পা,Ñতবু এই পথ তাঁকে পার হতে হবে। কেউ রান্নাবান্নার জন্য কাঁধে নিয়ে ফিরছেন গাছের শুকনা ডালপালা। কারও কাঁধে গবাদিপশুর জন্য তুলে নিয়ে আসা ঘাস। কেউ চরানো গরু নিয়ে ফিরছেন বাড়ির দিকে। কোথাও দু–চারজন দাঁড়িয়ে, নয়তো কোনো কালভার্টের ওপর বসে কথাবার্তা বলছেন, বিকেলের নরম বাতাসে গা ভিজিয়ে সময় পার করছেন।
দু–এক স্থানে দেখা গেছে, বেড়াতে আসা লোকজন পথে ঘুরছেন। টিলার ওপর উঠে ছবি তুলছেন। হঠাৎ করে এক–দুটা সিএনজিচালিত অটোরিকশা, মোটরসাইকেল, বাইসাইকেল কিংবা পিকআপ ভ্যান আসা-যাওয়া করছে। পথটি ভৈরববাজার থেকে মাইজদিহি চা-বাগান ও মিরতিংগা চা-বাগান হয়ে কমলগঞ্জ উপজেলার মুন্সিবাজারে গিয়ে মৌলভীবাজার-শমসেরনগর সড়কের সঙ্গে মিশেছে।
এই যে কিছু গাড়ির আনাগোনা চলছে, কিছু মানুষের দেখা মেলে। এটাই সড়কের প্রকৃত চেহারা। গাড়ি আসবে, গাড়ি যাবে। পথচারীরা পথ পার হবে। কিন্তু মুন্সিবাজার-ভৈরববাজার সড়কটি অন্য চেহারার, আলাদা। ওই পথে ধুলাউড়া গাড়ির চাপ তেমন নেই। মাঝেমাঝে গাড়ি আসে, হারিয়ে যায়। পথটির রূপকথা অন্য জায়গায়। ওখানে ‘আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই’। তবে ওখানে পাহাড় বলতে যা মনে করা যায়, সে রকম কিছু নেই। আছে অসংখ্য টিলা। টিলার শরীরভর্তি সবুজের ঢেউ। কখনো হেলান দেওয়া, কখনো খাড়া টিলার সারি। তাতে সারি সারি চায়ের গাছ গলাগলি করে দাঁড়িয়ে।
সড়ক ধরে যতটুকু সামনের দিকে যাওয়া গেছে, ততই সবুজের প্রাণখোলা উন্মুক্ত হৃদয়। উঁচু-নিচু টিলাগুলো সারা গায়ে সেই সবুজের চাদর জড়িয়ে আছে। মাঝেমধ্যে চা-বাগানের টিলার ফাঁকফোকর দিয়ে ধুলাপথ চলে গেছে আরও কোনো পথের দিকে। কেউ হয়তো একা, কেউ দলবেঁধে, কেউ গরু-বাছুর নিয়ে সেই পথে বাড়ির দিকে ফিরছেন। চকচক করা সাদা ধুলার রেখা পথচারীকে যেন পথ দেখিয়ে নিয়ে চলছে। স্থানটি এ রকম ‘যেখানে ঘুঘুর ডাকে অপরাহ্ণে শান্তি নামে মানুষের মনে।’ একটু পরপর বাঁক নিয়েছে পথ। গা মোচড় দিয়ে যেন আরও সবুজকে উন্মোচন করছে। শান্ত, নির্জন এই পথে কিছু ঝিঁঝিপোকা, কিছু অচেনা পাখির ডাক কেবল নৈঃশব্দ্যকে ভেঙেচুরে দেয়।
কবি ও সংগঠক আহমদ আফরোজ বলেন, ‘এটি একটি নান্দনিক সড়ক। সড়কের দুই পাশে চা-বাগান, সবুজে ঘেরা। এই রাস্তা দিয়ে যেতে মনে একধরনের প্রশান্তি অনুভূত হয়। আমি মাঝেমধ্যেই ঘুরতে যাই।’
তখন সন্ধ্যা তো কাছেই চলে এসেছে। পথে পথে ছায়া নামছে। অন্ধকার ঘন হয়ে আসছে। অনেক দূরে চা-বাগানের ছায়াবৃক্ষের ফাঁকে সূর্যের শেষ রশ্মি জ্বলছে, রাতকে কাছে টানছে। ফেরার তাগিদ হলে মনে হয় সেই ‘জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি-কুড়ি বছরের পার/তখন আবার যদি দেখা হয় তোমার আমার!’Ñএই পথে এ ধরনের অনুভূতি অনেককেই ছুঁয়ে যেতে পারে।