পাড়াগাঁয়ে টেবিল টেনিসের কারিগর

নজরুল টেবিল টেনিস একাডেমিতে অনুশীলনে ব্যস্ত কিশোর-তরুণেরা। সম্প্রতি রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার আন্দুয়া গ্রামে
ছবি: শহীদুল ইসলাম

৪৪ বর্গফুটের আধা পাকা ঘরটির চারপাশ খোলা। লোহার জালিকায় ঘেরা। ভেতরে তিনটি টেবিল পাতা। একটিতে খেলা চলছে। দুই কিশোরের ব্যাট আর বলের লড়াই জমে উঠেছে। টেবিল ঘিরে ভিড় করে আছে জনাদশেক কিশোর আর তরুণ। পাশে দাঁড়িয়ে খেলোয়াড় দুজনকে নির্দেশনা দিচ্ছেন প্রশিক্ষক। বাইরে অপেক্ষা করছে আরও কিছু কিশোর-কিশোরী। বাইরে সারি বাঁধা সাইকেল আর মোটরসাইকেলই বলে দিচ্ছে দূরদূরান্ত থেকেও অনেকে এসেছে।

টেবিল টেনিস খেলার এই আয়োজন কোনো নগরে নয়, বসেছে নিভৃত পল্লিতে—রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার আন্দুয়া গ্রামে। এই পল্লিগৃহে জেলা পর্যায়ের টেবিল টেনিস চ্যাম্পিয়নশিপেরও আয়োজন হয়। এখানে খেলা শিখে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খেলছে অনেকে।

নজরুল ইসলাম

ব্যস্তসমস্ত এই আঙিনা নজরুল টেবিল টেনিস একাডেমির। ৯ বছর ধরে এখানে কিশোর বয়সীদের টেবিল টেনিস প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন ক্রীড়া শিক্ষক নজরুল ইসলাম। একান্তই নিজের আগ্রহ, চেষ্টা আর খরচায় একাডেমিটি গড়ে তুলেছেন তিনি। তাঁর এই উদ্যোগকে এলাকার বিশিষ্টজনদের কাছে দারুণ অর্থবহ বলে মনে হচ্ছে। তাঁরা বলছেন, একালের কিশোর–যুবাদের মনোযোগ শুধু মুঠোফোনে। মাঠে গেলেও মুঠোফোন নিয়েই অলস সময় কাটায়। এই একাডেমি ওদের শরীর, মন ও জীবনের দিকে মনোযোগ টেনে এনেছে। তাই তো শুধু নয়, অনেকেই এখান থেকে জাতীয় পর্যায়ে কৃতিত্বের সঙ্গে খেলছে। কেউ কেউ জাতীয় সীমানার গণ্ডি পেরিয়ে পা রাখছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে।

বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (বিকেএসপি) টেবিল টেনিসের প্রধান কোচ খন্দকার মোস্তফা বিল্লাহ বলেন, এই একাডেমির খেলোয়াড়েরাই রাজশাহীকে বিভাগীয় চ্যাম্পিয়ন করেছে। সেখান থেকে শিখে এসে বিকেএসপির খেলোয়াড় নাফিজ ইকবাল (দলগত) সাউথ এশিয়ান টেবিল টেনিস চ্যাম্পিয়নশিপে দেশের জন্য জিতে এনেছে প্রথম সোনা। এখানকার পাঁচজন খেলোয়াড় গত মার্চে শেখ কামাল দ্বিতীয় বাংলাদেশ যুব গেমসেও (দলগত) সোনা জয় করেছে।

নিজ ঘরে সূচনা

নজরুল ইসলামের বাড়ি দুর্গাপুরের আন্দুয়া গ্রামেই। উপজেলার আমগাছি সাহার বানু উচ্চবিদ্যালয়ের ক্রীড়া শিক্ষক তিনি। স্ত্রী আর দুই ছেলে নিয়ে তাঁর সংসার।

নজরুল ইসলাম শুরু করেছিলেন নিজের ঘর থেকেই, দুই ছেলেকে দিয়ে। বড় ছেলে নাজুমল হুসাইনকে খেলা শিখিয়ে ভর্তি করেছিলেন বিকেএসপিতে। এখন খেলোয়াড় কোটায় ভর্তি হয়ে পড়ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে। ছোট ছেলে নাফিজ ইকবাল বিকেএসপিতে দশম শ্রেণির ছাত্র। নাফিজ ২০২২ সালে মালদ্বীপে সাউথ এশিয়ান টেবিল টেনিস জুনিয়র অ্যান্ড ক্যাডেট চ্যাম্পিয়নশিপের (অনূর্ধ্ব-১৯) দলগত ইভেন্টে সোনা জিতেছে।

চলতি মে মাসের ১৪ থেকে ১৮ তারিখে ভারতের অরুণাচলে অনুষ্ঠিত সাউথ এশিয়ান টেবিল টেনিস জুনিয়র অ্যান্ড ক্যাডেট চ্যাম্পিয়নশিপে নজরুল একাডেমির একজন ছেলে ও একজন মেয়ে ব্রোঞ্জ পদক পেয়েছে। গত ৯ বছরে নজরুল ইসলামের শিক্ষা পাওয়া ২৯ শিক্ষার্থী বিকেএসপিতে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে।

একাডেমির যাত্রা

নজরুল ইসলাম আমগাছি সাহার বানু উচ্চবিদ্যালয়ে ক্রীড়া শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন ২০০২ সালে। পড়াশোনার সঙ্গে শিক্ষার্থীরা যাতে ক্রীড়ানৈপুণ্যেও যোগ্য হয়ে ওঠে, নজরুল সেটা নিয়ে ভাবছিলেন। তাহলে অতিরিক্ত একটি যোগ্যতা অর্জনের পাশাপাশি সুযোগও বাড়ে। একবার বিকেএসপিতে ভর্তির সুযোগ পেলে পড়াশোনার জন্য আর ভাবতে হয় না। সেখানকার কোটাতেই উচ্চতর পড়াশোনার সুযোগ হয়। জীবিকার দুশ্চিন্তাও কমে যায়। নিজের ভাবনা প্রথমে তিনি প্রয়োগ করলেন বড় ছেলে নাজমুলের ওপরে। নাজমুল ২০১৩ সালে বিকেএসপিতে টেবিল টেনিস খেলোয়াড় হিসেবে ভর্তির সুযোগ পেল।

বিকেএসপির খন্দকার মোস্তফা বিল্লাহ দেখতে পেলেন, টেবিল টেনিস নিয়ে নজরুল ইসলামের দারুণ আগ্রহ। তাঁকে তিনি নিজের বাড়িতে একটা টেবিল কিনে বসাতে বলেন।

নজরুল টেবিল টেনিস একাডেমিতে প্রশিক্ষণ নিয়ে অনেকেই জাতীয় পর্যায়ে কৃতিত্বের সঙ্গে খেলছে
ছবি: প্রথম আলো

ঢাকা থেকে ফিরে গিয়েই নজরুল কাঠের টেবিল বানিয়ে নিজের ঘরে বসিয়ে দিলেন। পাড়ার ছেলেরা এসে টেবিল টেনিস খেলতে শুরু করে। ওদের আগ্রহ দেখে বছরখানেকের মাথায় নজরুলের মাথায় এল নিজের বাড়িতেই একাডেমি গড়ার চিন্তা। ২০১৪ সালে বাড়ির সঙ্গেই টেবিল টেনিসের একটি হল গড়ে তুললেন। গ্রামের একাডেমি বলে নজরুল নিয়ম ভাঙেননি। নিয়ম মেনে দৈর্ঘ্য–প্রস্থ রাখলেন ৪৪ বর্গফুট আর উচ্চতা সাড়ে ১২ ফুট। ওপরে টিনের চালা থাকলেও ভিতটি করলেন পাকা।

২০২১ সালে জেলা ক্রীড়া সংস্থা এই একাডেমিতে অনূর্ধ্ব-১৭ বালক-বালিকা টেবিল টেনিস চ্যাম্পিয়নশিপের দুটি খেলার আয়োজন করে। রাজশাহী জেলা ক্রীড়া সংস্থার অতিরিক্ত সাধারণ সম্পাদক শামসুজ্জামান বলেছেন, ব্যক্তি উদ্যোগে জেলায় এত ভালো আর কোনো প্রতিষ্ঠান নেই।

এককালীন ফি নিয়ে ভর্তি

শুরুতে একাডেমিতে কোনো খরচ নেওয়া হতো না। এখন ভর্তি ফি দেড় হাজার টাকা। সেখান থেকে খেলোয়াড়দের জন্যই এক হাজার টাকার ক্রীড়া সরঞ্জাম কিনে দেওয়া হয়। কেউ বিকেএসপিতে ভর্তির সুযোগ পেলে এককালীন ১০ হাজার টাকা নেওয়া হয়। সেটি একাডেমির উন্নয়নেই ব্যয় করা হয়।

টেনিস একাডেমি গড়তে নজরুলের খরচ হয় ১০ লাখ টাকা। নিজের জমানো দুই লাখ টাকা ছিল। বাকি আট লাখ টাকা তাঁর চাকরির ওপরে ব্যাংকঋণ নেওয়া। সে ঋণের শোধ হয়ে এসেছে প্রায়।

একাডেমির আঙিনায়

গত ৯ এপ্রিল আন্দুয়া গ্রামে ঢুকেই দেখা গেল, ছোট ছেলেমেয়েরা জার্সি পরে বাইসাইকেলে চেপে ছুটছে। বোঝা গেল, কাছেই কোথাও নজরুল টেবিল টেনিস একাডেমি। তাদের অনুসরণ করে পৌঁছানো গেল টেনিস একাডেমিতে। তিনটি টেবিলে অনুশীলন করছে শিক্ষার্থীরা। বাবারা করছেন অপেক্ষা।

শিক্ষার্থী মৃদুলের বাবা মাহাবুর রহমান কৃষিজীবী। তিনি বলেন, তাঁর ছেলে ও ভাইঝি বিকেএসপির এক মাসের ক্যাম্পে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে। ক্যাম্প শেষে ওরা বিকেএসপিতে ভর্তির সুযোগ পাবে বলে তাঁর প্রত্যাশা।

একাডেমির খেলোয়াড় মো. রুবেল হক এখন বিকেএসপির খেলোয়াড়। সে দশম শ্রেণিতে পড়ে। তার বাবা কৃষক জামাল উদ্দিন। তিনি বললেন, ‘নজরুল একাডেমি না থাকলে কি আমার মতো গরিব ঘরের ছেলেরা বিকেএসপিতে যেতে পারত?’

জান্নাতুন নামে এক শিক্ষার্থী গত বছর বিকেএসপিতে লন টেনিসে ভর্তির সুযোগ পেয়েছিল। কিন্তু সে ভর্তি হতে চায় ফুটবলে। তাই প্রতিদিন এখানে আসছে। ফেরার সময় পাশের গ্রামের বুলবুলি নামে আরেকটি মেয়েকে সে সাইকেলের পেছনে চাপিয়ে দিব্যি প্যাডেল চালিয়ে ছুটল। পাড়াগাঁর দৃশ্যপটই পাল্টে দিয়েছেন নজরুল ইসলাম।