খানজাহান (রহ.)–এর বসতভিটায় খননে মিলছে জীবনধারার নিদর্শন

খানজাহান আলী (র.) এর বসতভিটায় খনন করে পাওয়া প্রাচীন আমলের তৈজসপত্রসহ বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন
ছবি: প্রথম আলো

মুসলিম শাসক ও ধর্মপ্রচারকেরা ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করতে এবং তাঁদের শাসনকালের গৌরবকে তুলে ধরতে নানা ধরনের স্থাপত্য নির্মাণ করেছিলেন বলে ধারণা করা হয়। মধ্যযুগের এমন অসংখ্য নান্দনিক স্থাপত্য নিদর্শনের সন্ধান মেলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের উপকূলীয় জেলা বাগেরহাটে। এর মধ্যে অন্যতম ঐতিহাসিক ষাটগম্বুজ মসজিদ।

এবার ষাটগম্বুজ মসজিদের কাছে একটি ঢিবি খনন করেছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। যেখানে সন্ধান মিলেছে দুটি নির্মাণযুগ (সুলতানি ও মোগল) ও একটি পুনর্নির্মাণ পর্ব, সেই সময়কার বিভিন্ন স্থাপনার কাঠামোর ভিত্তি, মেঝে, নানা ধরনের টেরাকোটা, তৈজসপত্র, প্রাণির হাড়।

সম্প্রতি খনন করে পাওয়া এসব প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন দেখে ধারণা করা হয়, এখানেই হয়তো ছিল ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনামলের প্রাচীন নগর ‘খলিফাতাবাদ’-এর প্রতিষ্ঠাতা ‘খান উল আযম উলুঘ খান ই জাহান’–এর বসতভিটা। প্রাচীন ভৈরব নদের পূর্বমুখী বাঁকের দক্ষিণ পাড়ঘেঁষা বিশাল এই ঢিবি ২০০০ সালে অধিগ্রহণ করে সরকার। এর পর বুঝিয়ে দেওয়া হয় প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরে। ৯ দশমিক ৬৭ একর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত এই ঢিবি ষাটগম্বুজ মসজিদ থেকে মাত্র ৩০০ মিটার উত্তরে সুন্দরঘোনা গ্রামে।

স্থানটিতে ২০০১ সালে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর প্রথমবার প্রত্নতাত্ত্বিক খনন পরিচালনা করে। এর সাত বছর পর ২০০৮ সালে আবারও তারা খনন করে এখানে। এর পর থেকে প্রায় ধারাবাহিকভাবে এ পর্যন্ত মোট ১৩ বার ঢিবিটিতে খননে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন পাওয়া গেছে। যার মধ্যে সাড়ে ৬০০ বছর আগের হজরত খানজাহান (রহ.)–এর আমলের নানা স্থাপনা ও ইট বিছানো সড়ক, তাঁর আগে ও পরের বিভিন্ন যুগের স্থাপনা এবং ব্যতিক্রমধর্মী স্থাপনার নিদর্শন অন্যতম।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর বলছে, এখানে পাওয়া স্থাপনা, নানা ধরনের মৃৎপাত্র, চকচকে প্রলেপযুক্ত টাইলস, শৌখিন নানা তৈজস ও উপকরণ থেকে ধারণা করা যায়, সেই সময়ের বাসিন্দাদের জীবনযাত্রা, সংস্কৃতি ও রুচিবোধ অনেক উন্নত ছিল। বিভিন্ন সময়ে খনন করে পাওয়া স্থাপনায় সৃজনশীল নির্মাণশৈলী ও শৈল্পিক মননের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।

খানজাহান আলী (র.) এর বসতভিটায় খনন করে পাওয়া প্রাচীন আমলের তৈজসপত্রসহ বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন নিয়ে মঙ্গলবার প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়
ছবি: প্রথম আলো

বিভিন্ন সময় এ ঢিবি থেকে পাওয়া প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোর মধ্য থেকে যাচাই-বাছাই করে জাদুঘরে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। গত ৯ ফেব্রুয়ারি শুরু হওয়া চলতি অর্থবছরের খননকাজ শেষ হয়েছে আজ মঙ্গলবার। খনন শেষে ওই স্থান মাটি দিয়ে ঢেকে দেওয়া হচ্ছে।

খনন করে পাওয়া সামগ্রী নিয়ে মঙ্গলবার খানজাহান (রহ.)–এর বসতভিটা ঢিবি এলাকায় উন্মুক্ত প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। ওই প্রদর্শনীতে এসেছিলেন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের খুলনা ও বরিশাল বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক লাভলী ইয়াসমিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিগত বছরের খননগুলোতে বিভিন্ন বাড়িঘরের নির্মাণশৈলী, সে সময়কার পানিনিষ্কাশনের ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন নির্মাণকৌশলের নির্দশন মেলে। চলতি বছরে এগুলোর পাশাপাশি একটি বিশেষ ধরনের পোড়ামাটির প্রতীক আমরা পেয়েছি। যা থেকে আমরা ধারণা করছি, সেন্ট্রাল এশিয়া থেকে এই সিম্বল থারন কারি কোনো একটি গোত্রের এখানে প্রতিনিধিত্ব করেছে। গবেষণার কোনো শেষ কথা নেই। আশা করি, আরও নতুন নতুন অনেক তথ্য বেরিয়ে আসবে। এসব তথ্য আমাদের ইতিহাসকে আরও সমৃদ্ধ করবে।’

প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ বলছে, পুরো ঢিবি খনন শেষ করে স্থানটি সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারণা পেতে আরও বেশ কয়েক বছর সময় লাগবে। এরপর বিভিন্ন সময় খননে পাওয়া ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো সংস্কার ও সংরক্ষণের মাধ্যমে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হবে। এর আগে স্থানটির দক্ষিণ দিকে খননে বেরিয়ে আসা একটি ভবনের সিঁড়ির স্থাপত্যসহ কাঠামোর কিছুটা নিদর্শন বর্তমানে সেখানে দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত রয়েছে।’

বিশ্ববিখ্যাত ফোর্বস সাময়িকীতে প্রকাশিত বিশ্বের হারিয়ে যাওয়া ১৫টি ঐতিহাসিক নগরীর অন্যতম খলিফাতাবাদ। প্রাচীন এই শহরকে ১৯৮৫ সালে ‘ঐতিহাসিক মসজিদের শহর-বাগেরহাট’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে ৩২১ নম্বর ‘বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করে ইউনেসকো। খানজাহান (রহ.)–এর বসতভিটাও এই বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অন্যতম এক নিদর্শন, যার পাশে এখনো টিকে আছে প্রায় সাড়ে ৬০০ বছর আগে নির্মিত ইটে তৈরি প্রাচীন রাস্তা।

খানজাহান আলী (র.) এর বসতভিটায় খনন করে পাওয়া প্রাচীন আমলের তৈজসপত্রসহ বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন
ছবি: প্রথম আলো

বাগেরহাট জাদুঘরের কাস্টডিয়ান মো. যায়েদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এত দিন টিকে থাকা বিভিন্ন আকৃতির কয়েকটি মসজিদই কেবল খলিফাতাবাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্ব করেছে। নগর–পরিকল্পনার তাৎপর্যপূর্ণ কোনো বৈশিষ্ট্যের সন্ধান পাওয়া যায়নি। চলতি অর্থবছরে খননে দুই শতাধিক প্রত্নবস্তু নথিভুক্ত করা হয়েছে। মাটি খুঁড়ে এখানে আবিষ্কৃত মধ্যযুগের ধ্বংসপ্রাপ্ত নগরীর বিভিন্ন আলামত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বিলুপ্ত শহর খলিফাতাবাদের নগর–পরিকল্পনার নানা দিক সম্পর্কে মূল্যবান উপাদান ও প্রমাণ সংগ্রহ করেছি।’ এ থেকে বিশ্লেষণ করে নগরটি কী কারণে পরিত্যক্ত বা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল, তার কারণ অনুসন্ধান সম্ভব হবে বলেও মনে করে তিনি।