পাবনা শহরে প্রতি রাতে দুয়ারে সাহ্‌রি নিয়ে হাজির হন তাঁরা

রোজা শুরু হওয়ার পর থেকেই পাবনা শহরের বিভিন্ন সড়কে সাহ্‌রি বিতরণ করে যাচ্ছেন একদল তরুণ
ছবি: প্রথম আলো

রাত একটার পর পাবনা জেলা শহরে বের হলেই দেখা মেলে কিছু তরুণের। হাসপাতাল থেকে শুরু করে বাস টার্মিনাল, রাস্তা, বাজারে সাহ্‌রির প্যাকেট নিয়ে ছোটেন তাঁরা। রাতজাগা শ্রমিক থেকে শুরু করে হাসপাতালে থাকা রোগী ও তাঁদের স্বজন—সবার হাতে সাহ্‌রির প্যাকেট তুলে দিয়ে বাড়ি ফেরেন ওই তরুণেরা। প্রতি রাতে প্রায় এক হাজার মানুষের হাতে বিনা মূল্যের এই সাহ্‌রি তুলে দেওয়া হচ্ছে।

এর মধ্যে পাবনা জেনারেল হাসপাতাল ও দুটি মাদ্রাসায় ৭০০ থেকে ৭৫০ প্যাকেট পর্যন্ত সাহ্‌রি সরবরাহে অর্থায়ন করছে দেশের খ্যাতনামা শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্কয়ার। রাতে সাহ্‌রি রান্না ও প্যাকেট করে পৌঁছে দিচ্ছেন জেলা যুবলীগের কর্মীরা। এ ছাড়া শহরের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন তহুরা আজিজ ফাউন্ডেশন রাতজাগা শ্রমিক ও রিকশাচালকদের মধ্যে প্রতি রাতে আরও ২০০ থেকে ২৫০ প্যাকেট সাহ্‌রি বিতরণ করছে। দুটি প্রতিষ্ঠানের সাহ্‌রির প্যাকেটে ভাত, সবজি ও আলুভর্তার সঙ্গে দিনভেদে থাকছে মাছ, মাংস ও ডিম।

গত শনিবার রাতে শহর ঘুরে দেখা গেছে, ঈদ সামনে রেখে বেড়েছে মানুষের আনাগোনা। মধ্য শহরের রায়বাহাদুর গেটের সামনে সাহ্‌রি নিয়ে অটোরিকশায় করে ঘুরছেন কয়জন তরুণ। তাঁরা তহুরা আজিজ ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবী। নৈশপ্রহরী, রাত্রিকালীন রিকশাচালক, ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ী—যিনি হাত বাড়াচ্ছেন, তাঁর হাতেই তুলে দেওয়া হচ্ছে এক প্যাকেট সাহ্‌রি।

শহর ঘুরে রাত দুইটায় পাবনা জেনারেল হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, সাহ্‌রির অপেক্ষায় আছেন হাসপাতালে থাকা রোগী ও তাঁদের স্বজনেরা। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখানে সাহ্‌রি নিয়ে হাজির হন ২০ থেকে ২৫ জন তরুণ। হাসপাতালের কক্ষে ঘুরে ঘুরে সবার হাতে সাহ্‌রির প্যাকেট পৌঁছে দেন তাঁরা।

হাসপাতালে সাহ্‌রি বিতরণে ব্যস্ত তরুণেরা জানান, তাঁরা সবাই জেলা যুবলীগের নেতা-কর্মী। হাসপাতালে থাকা রোগী ও তাঁদের স্বজনদের রাতে সাহ্‌রি খাওয়া কঠিন হয়ে যায়। তাই এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। স্কয়ার গ্রুপের অর্থায়নে প্রতি রাতে হাসপাতালে প্রায় ৪০০ জনকে সাহ্‌রি সরবরাহ করা হচ্ছে। এ ছাড়া শহরের দুটি মাদ্রাসায় আরও তিন শতাধিক প্যাকেট সাহ্‌রি দেওয়া হচ্ছে।

পাবনা জেনারেল হাসপাতালে রোগীর স্বজনদের মাঝে সাহ্‌রি বিতরণ করা হচ্ছে। সম্প্রতি তোলা ছবি
প্রথম আলো

কথা হয় সাহ্‌রি হাতে পাওয়া কয়েকজন রোগী ও তাঁদের স্বজনদের সঙ্গে। তাঁরা জানান, হাসপাতালে ভর্তি থাকা অধিকাংশ রোগী গ্রাম থেকে এসেছেন। সন্ধ্যার খাবারটা তাঁরা হোটেল থেকে সংগ্রহ করতে পারেন। তবে রাতে সাহ্‌রি জোগাড় করা কঠিন ছিল। প্রতি রাতে সাহ্‌রি পেয়ে তাঁরা খুব উপকৃত হচ্ছেন।

জেলার চাটমোহর উপজেলার হান্ডিয়াল গ্রামে থেকে মেয়েকে নিয়ে তিন দিন ধরে হাসপাতালে আছেন আমেনা খাতুন নামের এক নারী। তিনি জানান, রাতে তাঁদের জন্য সাহ্‌রি তৈরি কোনো অবস্থাতেই সম্ভব নয়। তাই সাহ্‌রি সরবরাহ পেয়ে তাঁরা বেশ উপকৃত হয়েছেন।

শহরের রায়বাহাদুর গেটের সামনের মাছ বিক্রেতা শাহ আলম বলেন, প্রতি রাতেই এই তরুণেরা সাহ্‌রি নিয়ে আসেন। কাজের তাগিদে রাতে বহু মানুষকে বাড়ির বাইরে থাকতে হয়। তাঁরা ঠিকমতো সাহ্‌রি খেতে পারেন না। অনেকে খেজুর খেয়ে রোজা রাখেন। তরুণদের দেওয়া সাহ্‌রি খেয়ে রোজা রাখতে পারছেন অনেকে। শহরে রাতের রিকশাচালক আলতাফ হোসেন বলেন, ‘আমাগের কাজই গভীর রাতি, আগে তো চিড়ে-মুড়ি খায়েই রোজা থাকতেম। এহন ভাত পাই।’

জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক আলী মুর্তজা বিশ্বাস বলেন, ‘হাসপাতালে থাকা রোগী ও তাঁদের স্বজনেরা রাতে সাহ্‌রি খাওয়া নিয়ে খুব কষ্ট পাচ্ছিলেন। স্কয়ার গ্রুপের অর্থেই রোজার শুরু থেকে প্রতি রাতে সাহ্‌রি বিতরণ করা হচ্ছে। আমাদের কর্মীরাই বাজার থেকে শুরু করে রান্না ও খাবার প্যাকেট করে মানুষের হাতে পৌঁছে দিচ্ছেন।’

তহুরা আজিজ ফাউন্ডেশনের পরিচালক দেওয়ান মাহবুব বলেন, কয়েক বছর ধরেই তাঁরা জেলা শহর, কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল ও অনন্ত বাজার এলাকায় সাহ্‌রি বিতরণ করেন। মানুষের দানের টাকাতেই এই সাহ্‌রি কেনা হয়।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পাবনা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের পরিচালক এ বি এম ফজলুর রহমান বলেন, ‘দুটি সংগঠনই আন্তরিকতার সঙ্গে কাজটি করছে। আমি নিজে কয়েক দিন গিয়ে তাঁদের সঙ্গে সাহ্‌রি বিতরণে অংশ নিয়েছি। প্রতি রাতে সাহ্‌রি পেয়ে বহু মানুষ উপকৃত হচ্ছেন।’