যে মিষ্টির দোকানে রয়েছে একাত্তরের স্মৃতি

চট্টগ্রামের আনোয়ারার পরৈকোড়া ইউনিয়নের দত্তের হাটে অবস্থিত সুনীলের মিষ্টির দোকানটি একাত্তরের স্মৃতিবিজড়িত
ছবি: প্রথম আলো

টিন, কাঠ আর বেড়ার তৈরি দোকানঘর। বেশ পুরোনো আর জরাজীর্ণ। আগুনে পোড়া একটি গাছের গুঁড়িকে করা হয়েছে বেড়ার খুঁটি। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় হানাদার বাহিনী হাটে আগুন দিলে ওই দোকানও পুড়ে যায়। ধ্বংসাবশেষ থেকে আধপোড়া গাছের গুঁড়িটি তুলে এনে নতুন দোকানের খুঁটি করা হয়। দোকানের মালিক একাত্তরের স্মৃতি ধরে রাখতেই পোড়া গাছটিকে স্থান দিয়েছেন দোকানটিতে। ৭০ বছরের পুরোনো এ দোকান ‘সুনীলের মিষ্টির দোকান’ নামে পরিচিত।

দোকানে প্রতিদিন তৈরি হয় মিষ্টি, আমিত্তি, মিহিদানা, লংপুরি ও নিমকি। চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার পরৈকোড়া ইউনিয়নের দত্তের হাটে অবস্থিত মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিজাগানিয়া এ মিষ্টির দোকান।

বর্তমানে মিষ্টির ব্যবসার দেখাশোনা করেন সুনীল কান্তি দাশের ছেলে কানু দাশ। তিনি জানান, ১৯৫১ সালের দিকে সুনীল কান্তি দাশ হাটে মিষ্টির দোকানটি দেন। গোয়াল থেকে দুধ কিনে নিজেই মিষ্টিজাতীয় খাবার তৈরি করতেন। ওই সময় সুনীলের মিষ্টির সুনাম ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। দিনে দিনে জমে ওঠে দোকানটি। ব্রিটিশ আমলে স্থানীয় জমিদারেরা গোড়াপত্তন করেন দত্তের হাটের। একসময় হাটটি জমজমাট ছিল। স্থানীয় লোকজন ছাড়াও পাশের পটিয়া ও চন্দনাইশ উপজেলার বাসিন্দারাও এ হাটে এসে বাজারসদাই করতেন বলে জানান দত্তের হাটের ব্যবসায়ীরা।

কেন সুনীলের দোকানের মিষ্টির এত সুনাম, জানতে চাইলে এলাকার লোকজন বলেন, এখানকার মিষ্টি খাঁটি, সুস্বাদু আর দামেও সস্তা। সব জায়গায় মিষ্টির দাম বেড়ে গেলেও সুনীলের মিষ্টির দাম বাড়েনি। এখনো এ দোকানে প্রতিটি রসগোল্লা ১০ টাকা, আমিত্তি ৫ টাকা, এক প্লেট মিহিদানা ৫ টাকা, নিমকি ৫ টাকা এবং লংপুরি প্রতিটি ৫ টাকায় বিক্রি হয়। এ ছাড়া প্রতি কেজি রসগোল্লার দাম ২৫০ টাকা।

ব্যবসায়ী আনোয়ারুল আজিম চৌধুরী তাঁর কয়েক বন্ধুকে নিয়ে মিষ্টি খাচ্ছিলেন সুনীলের দোকানে। তিনি বলেন, ‘সুনীলের মিষ্টি মুখে দিলেই মনটা ভরে যায়। এত বছর ধরে সেই স্বাদ ধরে রাখা কম কথা নয়। আনোয়ারা-চন্দনাইশ সীমান্তে বরকল সেতুর গোড়ায় আমার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে কোনো মেহমান এলে সুনীলের দোকানে নিয়ে আসি। এখানকার মিষ্টি ছাড়া আপ্যায়ন সম্পূর্ণই হয় না।’

স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় দত্তের হাটে রাজাকার ও হানাদার বাহিনীর দেওয়া আগুনে পুড়ে যায় ৩০টি দোকান। সে সময় সুনীল কান্তি দাশের দোকানটিও পুড়ে যায়। রাজাকারেরা চলে গেলে ধ্বংসাবশেষ থেকে একটি পোড়া সোনালুগাছ তুলে এনে রেখে দেন সুনীল। পরে সেটি দোকানের খুঁটি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এখনো আগুনে পোড়া সোনালুগাছের খুঁটিটি ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে।

দত্তের হাটের দোকান বসত একটি বট আর একটি অশ্বত্থগাছের নিচে। আগুনে পুড়ে বটগাছটি মারা যায়। তবে কালের সাক্ষী হয়ে অশ্বত্থগাছটি আজও আগলে রেখেছে দত্তের হাটকে। দত্তের হাটের দোকানি হীরালাল শীল ও বাবুল ওয়াদ্দাদার বলেন, হাটের দোকানিরা সুনীলের দোকান থেকেই মিষ্টি কেনেন। এ ছাড়া পথচারীরা অনেকে দোকানে বসেই মিষ্টি খান।

কানু দাশের ছেলে রানা দাশ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষে চাকরি করতেন কৃষি ব্যাংকে। সেখান থেকে আরেকটি সরকারি পদে চাকরির আবেদন করে ১৬ হাজার পরীক্ষার্থীর মধ্যে ২য় স্থান অর্জন করেন। রানা দাশ বলেন, ‘প্রয়াত দাদা ও বাবা আমার আদর্শ। তাঁদের নিয়ে গর্ব করি। আমাদের দোকানটিও ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাক্ষী।’

বাবার আদেশ

ছোটবেলা থেকেই বাবার দেখাদেখি কানু দাশ শিখে নিয়েছিলেন মিষ্টি বানানোর কৌশল। ২০১৭ সালের ১৮ জানুয়ারি ৯১ বছর বয়সে মারা যান সুনীল কান্তি দাশ। এর আগে শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লে মেজ ছেলে কানু দাশের হাতে তুলে দেন দোকান। কানুর দুই ছেলে উচ্চশিক্ষা শেষ করে সরকারি বড় পদে কর্মরত। ছেলেরা চাইলেও বাবার পেশা ছাড়তে রাজি নন কানু।

কানু বলেন, ‘আমার বাবা আদেশ দিয়েছিলেন যেন তাঁর স্মৃতি ধরে রাখি। তাই বেচাকেনা কম হলেও দোকানটি ধরে রেখেছি। এখন সড়ক যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি হওয়ায় দূরদূরান্ত থেকেও ক্রেতারা দোকানে আসেন।’ কথা বলতে বলতে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন কানু দাশ। তিনি আরও বলেন, ‘বাবার হাতে গড়া দোকানটির প্রতি মায়া পড়ে গেছে। কোটি টাকা দিলেও আর কোথাও মন বসবে না।’