মিলনের ধোঁয়া ওঠা পিঠা মায়ের কথা মনে করায়
নোয়াখালী শহরে কর্মসূত্রে অনেকেই পরিবার ছাড়া একা থাকেন। কালেভদ্রে বাড়ি যাওয়ার সুযোগ পান তাঁরা। স্বজনদের সঙ্গ-সংস্পর্শের পাশাপাশি বাড়ির খাবারদাবারের স্বাদ থেকেও বঞ্চিত হতে হয় তাঁদের। এ ধরনের মানুষজনের অনেকেই মো. মিলনের কাছে আসেন পিঠা খেতে। গরম ধোঁয়া ওঠা পিঠা খেতে খেতে তাঁদের মায়ের কথা মনে পড়ে কি না, জানা যায় না। তবে মিলনের পিঠার স্বাদ যে কাউকে স্মৃতিকাতর করতেই পারে।
গত বৃহস্পতিবারের কথা। রাত তখন ১০টার মতো বাজে। ঘন কুয়াশায় ঢেকে গেছে পথঘাট। শহরের রাস্তায় লোকজন কমে এসেছে। তবে কলেজ রোডের কাশেম উকিল মোড়ে মো. মিলনের পিঠা বিক্রির ভ্যানগাড়ি ঘিরে অনেক মানুষের জটলা। কাছে যেতেই দেখা গেল, সারি সারি পাতিলে গরম ভাপা পিঠা, আর খোলায় চিতই পিঠা তৈরি হচ্ছে। গুড়, নারকেল, ভর্তা আর কাসুন্দির ঘ্রাণে ভরে আছে জায়গাটা। চুলা থেকে নামতেই গরম পিঠা হাতে তুলে নিচ্ছেন সামনে দাঁড়ানো লোকজন। এত রাতেও ভিড় বাড়ছিল। বিক্রেতা মিলন সেদিনকার মতো দোকান বন্ধ করতে চাইছিলেন। পরদিন একটা বিয়ের অনুষ্ঠানে পিঠা সরবরাহের বায়না নিয়েছেন, তাই দোকান বন্ধ করতে হবে। কিন্তু কে শোনে কার কথা।
নোয়াখালী জেলা শহর মাইজদীর লক্ষ্মীনারায়ণপুর এলাকার বাসিন্দা ৫৫ বছর বয়সী মিলন কখনো শহরের রাস্তার ধারে, কখনো শাখা সড়কের ব্যস্ততম মোড়ে, কখনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে কিংবা কারও কোনো অনুষ্ঠানে পিঠা বিক্রি করেন। পিঠা বিক্রি করেই চলে সংসার। চলছে সন্তানদের পড়ালেখা। দুই ছেলে মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে এখন কলেজে। দূরদূরান্ত থেকেও অনেক আসেন তাঁর হাতে বানানো নানা ধরনের পিঠা খেতে।
আট বছর ধরে পিঠা বিক্রি করছেন বলে জানালেন মিলন। ভাপা পিঠা, স্পেশাল ভাপা পিঠা, ঝাল চিতই, মিষ্টি চিতই, ডিম চিতই, রস চিতই, দুধ চিতই, হাঁস ও সাদা রুটি, মিষ্টি পুলি, নারকেল পুলি, পাটিসাপটা, ছাইয়া পিঠা, পানতোয়া পিঠা বিক্রি করেন তিনি। ঝাল চিতই, ডিম চিতই, ভাপা পিঠা ছাড়া বাকি পিঠাগুলো অর্ডার পেলে তৈরি করে সরবরাহ করেন। শহরের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, বাসাবাড়িতে প্রায় সময় তাঁর পিঠা সরবরাহের অর্ডার থাকে।
মিলন জানান, ঝাল চিতইয়ের সঙ্গে মুখরোচক ভর্তা, যেমন ইলিশভর্তা, শর্ষেভর্তা, রসুনভর্তা, শিমভর্তা, ধনেভর্তা, চিংড়িভর্তা, কালিজিরাভর্তাও বিক্রি করেন তিনি। পিঠা বিক্রির টাকায় তাঁর সংসার চলে।
একসময় মুদিপণ্যের দোকান করতেন মিলন। অনেক লোকসান গুনেছেন। ঋণের দায়ে পড়েছেন। এখন বৃদ্ধ মা ও স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে পিঠা বিক্রির টাকায় তাঁর সুখের সংসার।
মিলনের দোকানের সামনে আলাপ হয় মো. সোহেলের সঙ্গে। গরম-গরম ভাপা পিঠা খেতে খেতে তিনি বলেন, চাকরির কারণে পরিবার ছেড়ে এখানে থাকছেন। ঠিকমতো বাড়ি যাওয়া হয় না। তা ছাড়া বাড়িতে মা–ও নেই। মা মারা গেছেন কয়েক বছর আগে। শৈশবে শীতের রাতে কিংবা কুয়াশা মোড়ানো সকালে মা মাটির চুলায় ভাপা পিঠা তৈরি করতেন। মিলনের পিঠা মায়ের স্মৃতি এনে দিচ্ছে মনে।
শুক্রবার সকাল সাতটার দিকে পিঠা বিক্রেতা মিলনের সঙ্গে দেখা হয় শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণে। পিঠা বানাতে বানাতে হাসিমুখে মিলন বললেন, এখানে একটি সামাজিক সংগঠনের ছেলেমেয়েরা কুয়াশা উৎসবের আয়োজন করেছে। এই অনুষ্ঠানে ভাপা পিঠা সরবরাহের অর্ডার নিয়েছেন তিনি। সে জন্য ভোরে এসে হাজির হয়েছেন। গরম-গরম পিঠা তৈরি করে সরবরাহ করছেন। কারও কম মিষ্টি পছন্দ, কারও বেশি মিষ্টি। যে যেভাবে চাইছেন, তাঁকে সেভাবেই পিঠা তৈরি করে দিচ্ছেন।
মিলনের পিঠা খেতে ১০ বছরের নাতিকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন জয়নাল আবদিন (৬০)। দুজনে মিলে বেশ কয়েকটা ভাপা পিঠা শেষ করলেন। খেতে খেতে জয়নাল আবদিন প্রথম আলোকে বলেন, এখন শহরের জীবনে নানা ব্যস্ততা। বাচ্চাদের পড়ালেখা, সংসারের নানা কাজকর্মের চাপের কারণে বাসাবাড়িতে নারীরা আগের মতো পিঠা বানানোর সময়ও পান না। মিলনের পিঠার স্বাদ একেবারে বাসাবাড়ির মতো।