বগুড়ার মহাসড়কে ‘টোকেন’ আর ‘লাইন খরচ’ দিয়ে চলছে তিন চাকার যান

বাস–ট্রাকের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অবৈধভাবে বগুড়া- নাটোর মহাসড়কে চলছে সিএনজিচালিত অটোরিকশা। বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার বয়রাদিঘী এলাকায়ছবি: সোয়েল রানা

বগুড়ায় বৈধ যানবাহনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মহাসড়কে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও ব্যাটারিচালিত ইজিবাইকের মতো তিন চাকার যান। এতে প্রতিনিয়তই সড়কের বিভিন্ন স্থানে দুর্ঘটনা ঘটছে। মহাসড়কে চলাচলকারী বাস, ট্রাকসহ বড় যানের চালক ও মালিক বরাবরই এসব তিন চাকার যানের বিরুদ্ধে অবস্থান করছেন। পুলিশ প্রশাসনও বলছে, তিন চাকার যানবাহন চলাচল শূন্যের কোঠায় আনতে সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে।

তবে বাস্তব চিত্র পুরোপুরি ভিন্ন। বগুড়ার ওপর দিয়ে চলে যাওয়া ঢাকা-রংপুর ও বগুড়া-নাটোর মহাসড়কে নামলেই অটোরিকশা, ইজিবাইক, টমটম, ভটভটি, নছিমনসহ বাহারি নামের তিন চাকার যানের দেখা মেলে। কোথাও ‘টোকেন’ আবার কোথাও ‘লাইন খরচ’ দিয়ে মহাসড়কে চলছে এসব যানবাহন।

বগুড়া জেলা পুলিশের পরিসংখ্যান বলছে, গত বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত জেলার বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কে ৬৪টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে ৭৭ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। আহত হয়েছেন ৬৭ জন। অন্যদিকে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ১৩ মার্চ পর্যন্ত আরও ২৩ জনের মৃত্যু হয়েছে সড়কে।
সর্বশেষ গত সোমবার সকালে বগুড়া-নাটোর মহাসড়কের নন্দীগ্রাম উপজেলার কুন্দারহাট বাসস্ট্যান্ড এলাকায় সিএনজিচালিত অটোরিকশার সঙ্গে পিকআপ ভ্যানের মুখোমুখি সংঘর্ষে শিশুসহ তিনজন নিহত হন। আহত হন আরও পাঁচজন।

গত বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত জেলার বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কে ৬৪টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে ৭৭ জনের প্রাণহানি ঘটেছে।

হাইওয়ে পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের বগুড়া অংশের ৬৬ কিলোমিটার ও বগুড়া-নাটোর মহাসড়কের ৬২ কিলোমিটার অংশে প্রায় প্রতিদিনই ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটছে। সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনার কারণগুলোর মধ্যে আছে বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, ওভার টেকিং, মদ্যপ অবস্থায় কিংবা ঘুম ঘুম চোখে গাড়ি চালানো, বারবার লেন পরিবর্তন, গাড়ি চালানোর সময় মুঠোফোনে কথা বলা ইত্যাদি। এ ছাড়া অবাধে ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল, মহাসড়কে ঝুঁকিপূর্ণ বাঁকও দুর্ঘটনার জন্য সমান দায়ী। তবে চালক ও যাত্রীদের অভিযোগ, মহাসড়কে তিন চাকার যানের অবাধে চলাচলের কারণে দুর্ঘটনা বাড়ছে।

সম্প্রতি ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের শেরপুর থেকে মোকামতলা পর্যন্ত ঘুরে দেখা গেছে, মহাসড়কে অনিয়ন্ত্রিতভাবে তিন চাকার বিভিন্ন যানবাহন যাত্রী পরিবহন করছে। এসব যানের অধিকাংশ চালকই অপেশাদার ও অদক্ষ। শিশু ও কিশোর চালকের সংখ্যাও নেহাত কম নয়।

বনানী থেকে নয়মাইল রুটে মহাসড়কে সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালান শহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, মহাসড়কে সিএনজিচালিত অটোরিকশা কোনো দিনই বন্ধ হবে না। কারণ, প্রতি মাসে এক হাজার টাকার ‘টোকেন’ নিয়ে মহাসড়কে অটোরিকশা চালাতে হয়। অটোরিকশা মালিক সমিতির লোকজন তাঁদের এই টোকেন সরবরাহ করেন।

মহাসড়কে নামলেই অটোরিকশা, ইজিবাইক, টমটম, ভটভটি, নছিমনসহ বাহারি নামের তিন চাকার যানের দেখা মেলে
ছবি: সোয়েল রানা

এই মহাসড়কে কয়েক শ অটোরিকশা চলে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজ চালক বলেন, টোকেনের টাকা হাইওয়ে পুলিশ, থানা-পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের পকেটে চলে যায়। তাই তাঁরাও নির্বিঘ্নে যাত্রী পরিবহন করছেন।

সাগর নামের এক কিশোর চালক বলে, ‘রাস্তার পাশ দিয়ে অটোরিকশা চালাই। কোনো সমস্যা হয় না। মাঝেমধ্যে যখন বড় বড় বাস ও ট্রাক যায়, তখন একটু সচেতন থাকতে হয়। মাসে এক হাজার টাকা দেই, কেউ মামলা দেয় না।’

এদিকে বগুড়া-নাটোর মহাসড়কের অটোরিকশা চালাতে দিতে হয় ‘লাইন খরচ’। চালকদের দাবি, হাইওয়ে পুলিশকে এই টাকা দিতে হয়। বগুড়ার সাতমাথা থেকে নন্দীগ্রাম রুটের অটোরিকশাচালক রাসেল মিয়া বলেন, হাইওয়ে পুলিশকে প্রতি মাসে এক হাজার টাকা ‘লাইন খরচ’ দিয়ে এই রুটে সিএনজি চালাতে হয়। সিএনজি চলাচলে চালকের চেয়ে পুলিশের উৎসাহ বেশি বলে মনে করেন তিনি।

পশ্চিমাঞ্চল হাইওয়ে পুলিশের বগুড়ার পুলিশ সুপার মো. হাবিবুর রহমান বলেন, মহাসড়কে তিন চাকার অযান্ত্রিক যানবাহন চলাচল শূন্যের কোঠায় আনতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো হচ্ছে। মহাসড়কে সব ধরনের তিন চাকার যান চলাচল বন্ধে হাইওয়ে পুলিশের প্রতিটি থানা ও ফাঁড়িকে কঠোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

চালকদের কাছ থেকে ‘টোকেন’ ও ‘লাইন খরচে’র মাধ্যমে টাকা আদায়ের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে হাবিবুর রহমান বলেন, বিষয়টি তিনি জানেন না। তবে হাইওয়ে পুলিশের কেউ অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকলে তদন্ত করে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ঢাকা থেকে রংপুরগামী দূরপাল্লার বাসের চালক জয়নাল আবেদীন বলেন, মহাসড়কে দুর্ঘটনার প্রধান কারণ নছিমন, করিমন, ভটভটি, ইজিবাইক আর সিএনজি। এসব যানবাহনের চালকেরা কোনো ট্রাফিক আইন মানে না। সিগন্যাল না মেনে বাস-ট্রাকের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটে।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন রাজশাহী বিভাগীয় কমিটি এবং সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম বলেন, মহাসড়কে এসব অবৈধ যানবাহন বন্ধের জন্য বহুবার প্রশাসনের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছেন, আন্দোলনও করেছেন। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। সড়কে এখন অবৈধ যানবাহনের চেয়ে অবৈধ যানবাহনের দাপট বেশি। সড়কে তিন চাকার অবৈধ যানবাহন দাপানো বন্ধ হলেই দুর্ঘটনা কমে আসবে।