বিদ্যালয়ের সেই নলকূপে আগেও মেশানো হয় বিষ, আলোচনায় পরিচালনা কমিটির দ্বন্দ্ব

নলকূপের পানিতে বিষ মেশানোর ঘটনায় বিদ্যালয়ে গ্রাম পুলিশের পাহারা বসানো হয়েছে। গতকাল নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার জিগরী উচ্চবিদ্যালয়ে
ছবি: প্রথম আলো

নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার জিগরী উচ্চবিদ্যালয়ের সেই নলকূপে চার বছর আগেও একবার বিষ মেশানোর ঘটনা ঘটেছিল। তখন নলকূপের পানি পান করে অসুস্থ হয়ে এক ছাত্রী হাসপাতালে ভর্তিও হয়েছিল। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় আবারও একই ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ করেছেন অভিভাবক ও স্থানীয় লোকজন। গত মঙ্গলবার এই নলকূপের পানি পান করে অসুস্থ তিন ছাত্রী বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

এ ঘটনার পর বিদ্যালয়ে গ্রাম পুলিশের পাহারা বসানো হয়েছে। গঠন করা হয়েছে তদন্ত কমিটি। সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপনেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। থানায় করা হয়েছে সাধারণ ডায়েরি। তবে নলকূপে পানি পরীক্ষার ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের জের ধরে এই নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড ঘটতে পারে বলে ধারণা করছেন স্থানীয় লোকজন।

গতকাল বুধবার সরেজমিনে দেখা যায়, নলকূপটির অবস্থান জিগরী উচ্চবিদ্যালয়ের উত্তর-পশ্চিম কোণে। প্রবেশপথ ছাড়া বাকি অংশ পাকা দেয়ালে ঘেরা। বিদ্যালয় চালু থাকাকালে দেয়াল টপকে সেখানে ঢোকা প্রায় অসম্ভব। নলকূপটির একপাশে শিক্ষককক্ষ। অন্য পাশে ছাত্রীদের বিশ্রামাগার। এখানে ছাত্রদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক লোকমান হোসেন বলেন, নলকূপটি শুধু মেয়েরাই ব্যবহার করে। ঘটনার দিন সকাল ৯টা থেকে ৯টা ৫০ মিনিট পর্যন্ত মেয়েদের অনেকেই ওই নলকূপের পানি পান করেছে। তারা অসুস্থ হয়নি। কিন্তু এর পরে যারা পানি পান করেছে তারা অসুস্থ হয়েছে। তখন পানি তুললে পানির রং দুধের মতো সাদা ও বিষের দুর্গন্ধ পাওয়া যায়। তবে এ সময়ের মধ্য কে বিষ মিশিয়েছে, তা কেউ দেখেনি।

আরও পড়ুন

এমন নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে প্রধান শিক্ষক বলেন, বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা শুধু পরিচালনা কমিটি নিয়ে। প্রায় আট মাস আগে নতুন সভাপতি আমিরুল ইসলাম দায়িত্ব নিয়েছেন। এরই মধ্যে আগের সভাপতি (উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি) ওসমান গণি তাঁর নিয়োগ বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেছেন। তিনি বিভিন্ন লোকজনের কাছে বিদ্যালয়ের অনিষ্ট সাধনের প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়েছেন বলেও শোনা যাচ্ছে।

অবশ্য ওসমান গণি দাবি করেছেন, বিষ মেশানোর ঘটনার সঙ্গে বিরোধের সম্পর্ক নেই। অনিষ্ট করার প্রকাশ্য ঘোষণার অভিযোগও সঠিক নয়। তিনি বলেন, ‘আগের ঘটনার সময় আমি সভাপতি ছিলাম। আমার বিরুদ্ধে বর্তমান সভাপতি অনেক অভিযোগ করেছেন।’ শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তায় আগের ও বর্তমান কমিটির ব্যর্থতার কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘ছেলে-মেয়েদের নিরাপত্তার ব্যাপারে আমাদের আরও কিছু করা উচিত ছিল।’

বিদ্যালয়ের নলকূপের পানি পান করে অসুস্থ হওয়া শিক্ষার্থী। নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে
ছবি: প্রথম আলো

বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির বর্তমান সভাপতি আমিরুল ইসলাম বলেন, ‘তিনি (ওসমান গণি) আইনের আশ্রয় নিয়েছেন। এতে তো সমস্যা দেখি না। বিশ্বাসও করি না, তিনি আমার ওপর প্রতিশোধ নিতে সাড়ে পাঁচ শ ছেলেমেয়েকে হত্যার ষড়যন্ত্র করবেন। কারণ, আমরা কেউ স্বচক্ষে বিষ মেশাতে দেখিনি। তবে কেউ না কেউ তো ঘটনাটি ঘটিয়েছে। প্রশাসন অপরাধীকে শনাক্ত করুক।’

স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের ৫ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য সেলিম রেজার মেয়ে এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। সেলিম রেজা বলেন, ‘পানিতে বিষ মেশানোর ঘটনায় আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে খুবই চিন্তিত। কারণ, নলকূপের পানি সব ছাত্রছাত্রীরাই পান করে। এতে আরও অনেকেই অসুস্থ হতে পারত, মারা যেতে পারত। অথচ ঘটনা ঘটার পর কর্তৃপক্ষ ন্যূনতম দায়িত্বও পালন করে না।’

ছাত্রীদের শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে বাগাতিপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক বলেন, বিষক্রিয়ায় ছাত্রীদের চোখে রক্ত জমে যাওয়া, মাথাব্যথা করা ও শরীর জ্বলে যাওয়ার মতো অসুবিধা হয়েছিল। তবে চিকিৎসায় তারা সুস্থ হয়ে উঠছে। তবে পানিতে বিষের ধরন ও পরিমাণ কী ছিল, তা জানার জন্য নলকূপের পানি পরীক্ষা করা জরুরি।

উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, খবর পেয়ে তাঁরা ওই নলকূপের পানির নমুনা সংগ্রহ করেছেন। পানির রং দেখে ও গন্ধ নিয়ে বলা যায়, পানিতে বিষ মেশানো হয়েছে। তবে যন্ত্রপাতি না থাকায় পরীক্ষা করতে পারেননি। পুলিশ ইচ্ছা করলে পানি পরীক্ষার জন্য বিএসটিআই ল্যাবে পাঠাতে পারে।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক লোকমান হোসেন বলেন, ঘটনার পর গতকাল বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী থানায় সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে। পাশাপাশি বিদ্যালয়ে সিসি ক্যামেরা স্থাপন ও প্রশাসনের সহায়তায় গ্রাম পুলিশের পাহারা বসানোর সিদ্ধান্ত হয়। ঘটনার তদন্তে বিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ সহকারী শিক্ষক আফরোজা খাতুনকে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিতে তিন কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

জেলা প্রশাসক আবু নাছের ভূঞা বলেন, ঘটনাটি তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের শনাক্ত ও কী কারণে এটা করা হয়েছে, তা উদ্‌ঘাটনের চেষ্টা চলছে। বিদ্যালয়ে সিসিটিভি ক্যামেরা বসানোর আগপর্যন্ত গ্রাম পুলিশ মোতায়েন থাকবে।