সুন্দর শহরখ্যাত রাজশাহী যেসব কারণে বৃষ্টিতে জলমগ্ন হলো

বৃষ্টির পানি জমে আছে সড়কে। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন বাসিন্দারা। আজ শুক্রবার সকালে রাজশাহী নগরে বহরমপুর এলাকায়ছবি: শহীদুল ইসলাম

দেশের সুন্দর শহর হিসেবে খ্যাত রাজশাহী মহানগর। ভারী বৃষ্টিতে এই শহর কেন জলমগ্ন হয়ে পড়ল, এ প্রশ্ন এখন নগরবাসীর মুখে মুখে। তবে গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরের পর থেকে আর ভারী বৃষ্টি না হওয়ায় ইতিমধ্যে প্রধান শহরের পানি নেমে গেছে। আজ শুক্রবার সকালেও অল্প কয়েকটি জায়গায় পানি আটকে ছিল। তাতে দুর্ভোগ হচ্ছে। ছিটেফোঁটা বৃষ্টিও পড়ছে।

সিটি করপোরেশন বলছে, যত্রতত্র বাড়ি নির্মাণের জন্য ড্রেনের ওপর বালু ফেলে রাখা, ড্রেনগুলো চার বছর ধরে পরিষ্কার না করা, পানি নির্গমনের খালে বাঁধ দিয়ে পাট জাগ দেওয়ার কারণে শহর জলমগ্ন হয়ে পড়েছিল। অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে জলাবদ্ধতা হচ্ছে বলে অভিযোগ নগরের বাসিন্দাদের।

আবহাওয়া অফিসের তথ্যমতে, ১০ বছরের মধ্যে গতকাল রাজশাহীতে এক দিনে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হয়েছে। বৃষ্টিতে শহরের রাস্তাঘাট জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। এতে জনদুর্ভোগ বেড়েছে। মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর নির্বাচনী পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। তবে এই দুর্ভোগের মধ্যে নগরের পাড়ামহল্লায় লোকজন জাল নিয়ে মাছ ধরার উৎসবে মেতে ওঠে।

আরও পড়ুন

আজ সকালে সরেজমিনে দেখা যায়, নগরের বর্ণালি মোড়ের দক্ষিণ পাশে এখনো পানি রয়েছে। গতকাল সেখানে পারাপারের জন্য নৌকা ব্যবহার করা হয়েছিল। নগরের মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্সের সামনের সড়ক এখনো ডুবে রয়েছে। সেখান থেকে নগরের অচিনতলা পর্যন্ত একই অবস্থা। নগরের ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের তেরখাদিয়া কলেজপাড়ার প্রায় ১০০ বাড়িঘরে এখনো পানি রয়েছে। এই মহল্লার কলি বেগম ও সাবিনা বেগম বলেন, তাঁদের বাসায় চুলা জ্বালানোর উপায় নেই। বাধ্য হয়ে চার-পাঁচটা পরিবার একসঙ্গে উঁচু একটি জায়গায় চুলা করে খিচুড়ি রান্না করে খাচ্ছেন। এখনো তাঁদের ঘর থেকে পানি নেমে যায়নি।

রাজশাহী নগরের কিছু এলাকার বাড়িঘরেও পানি উঠেছে। আজ শুক্রবার সকালে নগরে ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের কলেজপাড়া এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

তেরখাদিয়া কলেজপাড়ার ভ্যানচালক শহীদুল ইসলামের ঘরে পানি ঢুকেছে গত বুধবার দিবাগত রাতে। তিনি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে শুকনা এলাকায় অন্য একটা ঘর সাময়িক ভাড়া নিয়ে আছেন। আজ বেলা ১১টার দিকে তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, এখনো সেখানে পায়ের পাতাডোবা পানি রয়েছে।

এদিকে শহরের পানিতে নগরের দক্ষিণ নওদাপাড়ার সিলিন্দা এলাকায় সবজিখেত ডুবে গেছে। আজ সকালে চাষি মামুনুর রশিদ তাঁর জমি থেকে পুঁইগাছ কেটে তুলছিলেন। তিনি বলেন, শহরের ঢলে তাঁর দুই বিঘা পুঁইখেত ডুবে গেছে। এর আগেও বড় বৃষ্টি হলে পানি আসত, কিন্তু এভাবে কোনো দিন খেত ডুবে যায়নি। একাই এলাকার রেজাউল ইসলামের তিন বিঘা সবজিখেত ডুবে গেছে। তিনি বলেন, যে ড্রেন তৈরি করেছে, সেই ড্রেনে পানি ধরছে না। ড্রেন উপচে এলাকা ডুবে গেছে। এর আগে এ রকম কখনো হয়নি।

আরও পড়ুন
ভারী বৃষ্টিতে রাজশাহী নগরীর বিভিন্ন সড়কে জমে পানি। গতকাল রাজশাহী নগরের সপুরা এলাকায়
ছবি: শহীদুল ইসলাম

সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, ব্রিটিশ আমলে পদ্মা নদী থেকে শহরের ভেতর দিয়ে উত্তর পাশের বারোনই নদে পানি নেমে যাওয়ার জন্য আটটি বড় ড্রেন করা হয়েছিল। এই বড় ড্রেন ছাড়াও অলিগলির ড্রেন মিলে শহরে মোট ২২২ কিলোমিটার ড্রেন রয়েছে। গত চার বছর ধরে ড্রেনগুলো পরিষ্কার করা হয়নি। দরপত্র আহ্বান করে এই ড্রেন পরিষ্কার করা হয়।

এদিকে বড় আটটি ড্রেনের পানি একটি খাল দিয়ে শহরের উত্তর পাশের বারোনই নদে গিয়ে পড়ে। অনাবৃষ্টির সময় স্থানীয় লোকজন এই খালে বাঁধ দিয়ে পাট জাগ দিয়েছিলেন এবং খালের পানি দিয়ে জমিতে সেচ দিয়েছিলেন। এসব কারণে শহরের পানি নিষ্কাশিত হতে দেরি হয়েছে।

আরও পড়ুন

রাজশাহীর পরিবেশবাদী সংগঠন হেরিটেজের প্রতিষ্ঠাতা নদীগবেষক মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, নিয়ম অনুযায়ী বছরে অন্তত চারবার শহরের ড্রেনগুলো পরিষ্কার করতে হবে। কারণ, এই ড্রেনের মধ্যে পলিথিন, শক্ত বর্জ্য—সবই ফেলা হয়। এগুলো নিয়মিত পরিষ্কার না করায় পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়।

জানতে চাইলে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নূর ইসলাম বলেন, ড্রেনগুলো দরপত্র আহ্বান করে পরিষ্কার করতে হয়। ৩-৪ বছর আগে ৭০ লাখ টাকা ব্যয়ে পরিষ্কার করা হয়েছিল। আবার পরিষ্কার করা হবে। আগামী মার্চ–এপ্রিলের পরে আর এ সমস্যা থাকবে না। আর খালের মুখে পাট জাগ দেওয়ার জন্য স্থানীয় লোকজন বাঁধ দিয়েছিলেন। সেই বাঁধ গতকাল অপসারণ করা হয়েছে। বর্ণালি এলাকার পেছনে পাকিস্তান আমলের একটি কালভার্ট আছে। সিঅ্যান্ডবি মোড়ের বিপরীতে পদ্মার বাঁধে যে স্লুইচগেট আছে, সেটা সরু। পানি নামছে কম। এগুলো ঠিক করার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডকে বলা হয়েছে। সেটা করলেই আর সমস্যা থাকবে না।

রাজশাহীতে গতকাল দুপুর পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ২৪৫ দশমিক ৮ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। আবহাওয়া অফিসের তথ্যমতে, ১০ বছরের মধ্যে এটি রাজশাহীতে বড় বৃষ্টিপাত।

জলাবদ্ধতার জন্য অপরিকল্পিত নগরায়ণকে দুষলেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) রাজশাহী জেলার সভাপতি আহমদ সফি উদ্দিন। তিনি বলেন, গত দশ বছরেও সড়কের নিচ দিয়ে বড় মোটা পাইপে সুয়ারেজ লাইন করতে ওয়াসা ব্যর্থ হয়েছে। হাইকোর্টের নির্দেশনা না মেনে শত শত পুকুর ভরাট করা হয়েছে। পদ্মার বাঁধে ব্রিটিশ আমলের স্লুইসগেটগুলো থেকে নগরের উত্তরে প্রবাহিত ড্রেনগুলো ছোট করে ফেলে জনগণকে জায়গা দখলের সুযোগ করে দেওয়া এবং পানিপ্রবাহের গতি ধীর করা হয়েছে। ২৫ বছর আগে নগরের ড্রেনেজ প্রকল্পের এই ভুলের ওপর ভিত্তি করেই আজও প্রাইমারি, সেকেন্ডারি ও টারশিয়ারি ড্রেনেজ প্রকল্প চলছে।

জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ১০০ বছরের উন্নয়ন মহাপরিকল্পনা না করে অপরিকল্পিত উন্নয়ন করা হচ্ছে উল্লেখ করে আহমদ সফি উদ্দিন আরও বলেন, সড়ক পুনর্নির্মাণ ও সংস্কারের সময় নিয়মানুযায়ী উচ্চতা ও ঢাল অনুরূপ না রেখে বছর বছর উঁচু করায় নগরজুড়ে ড্রেনের ঢালও এলোমেলো হয়ে গেছে। বাড়ি নিচু হয়ে পানি ঢুকে পড়ছে। আরেকটি হচ্ছে উন্নয়ন পরিকল্পনা করার আগে বিধিমোতাবেক বিশেষজ্ঞ, অভিজ্ঞ নাগরিকদের পরামর্শ গ্রহণে ব্যর্থতা এবং জনপ্রতিনিধি ও নাগরিকদের উদাসীনতা রয়েছে।

বৃষ্টির পানি উঠেছে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেও। আজ শুক্রবার সকালে রাজশাহী নগরে বহরমপুর এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো
আরও পড়ুন

দ্রুত নগরের পানি না নামার আরও কিছু কারণের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, নগরবাসীর ফেলা আবর্জনা ও পলিথিনে ড্রেনের পানিপ্রবাহ বাধা পায়। নগরের উত্তরের খাল–বিল–নদী ভরাট, দখল ও বেআইনি স্থাপনার কারণে পানি নামতে বাধা পায়। নীতিমালা না মেনে ভবন নির্মাণকারীদের বিরুদ্ধে আরডিএর ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যর্থতাকেও দুষলেন তিনি।

রাজশাহীতে গতকাল দুপুর পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ২৪৫ দশমিক ৮ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। আবহাওয়া অফিসের তথ্যমতে, ১০ বছরের মধ্যে এটি রাজশাহীতে বড় বৃষ্টিপাত।
আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, আজ ঢাকা, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের অনেক জায়গায় অস্থায়ী দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। রংপুর, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি হতে পারে।

আরও পড়ুন