রাজশাহী জেলার মানচিত্র

‘পানি নিতে গেলে অপারেটর দুই থেকে পাঁচ দিন ধরে ঘোরান। পানির সিরিয়াল দেওয়া হয় রাতে। আগে বাঙালি কৃষকদের পানি দেওয়া হয়। আমরা দেরি করে পানি পাই। তাই আমাদের ফসল কম হয়। বাঙালি চাষিদের কাছে ১৫০ টাকা নেওয়া হলেও আমাদের কাছ থেকে আদায় করা হয় ২০০ টাকা।’ এভাবেই বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) গভীর নলকূপের অপারেটরের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানান ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নারী ক্যাথরিনা হাঁসদা। তাঁর বাড়ি রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার গড়ডাইং গ্রামে।

ক্যাথরিনা হাঁসদার মতো ওই এলাকার ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষেরা গভীর নলকূপের অপারেটরদের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিস্তর অভিযোগ করেছেন। গতকাল শনিবার রাজশাহী নগরে বিএমডিএর সদর দপ্তরের সম্মেলন কক্ষে মতবিনিময় সভায় তাঁরা এসব অভিযোগ করেন। সিসিবিভিও নামের একটি বেসরকারি সংস্থা বরেন্দ্র অঞ্চলের প্রান্তিক কৃষকের সঙ্গে বিএমডিএর কর্মকর্তাদের মতবিনিময়ের আয়োজন করে।

চাষের আগেই অপারেটর টাকা চান, গভীর রাতে পানি নিতে ডাকা হয়। অপারেটর হিসেবে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষকেও রাখতে হবে।
ঝরনা লাকড়া, রাজশাহীর গোদাগাড়ীর বাসিন্দা

এতে সভাপতিত্ব করেন রক্ষাগোলা সমন্বয় কমিটির সভাপতি সরল এক্কা। রক্ষাগোলা হচ্ছে সিসিবিভিও পরিচালিত রাজশাহীর ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর গ্রামভিত্তিক স্থিতিশীল খাদ্যনিরাপত্তা কর্মসূচি।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বিএমডিএর চেয়ারম্যান বেগম আখতার জাহান। বিশেষ অতিথি ছিলেন বিএমডিএর নির্বাহী পরিচালক আবদুর রশীদ, গোয়েন্দা শাখার অবসরপ্রাপ্ত সহকারী পরিচালক সুনন্দন দাস ও সিসিবিভিওর নির্বাহী প্রধান সারোয়ার-ই কামাল। সভা সঞ্চালনা করেন সিসিবিভিওর কর্মসূচি সমন্বয়কারী মো. আরিফ।

কি-নোট পেপার উপস্থাপন করেন সংগঠনের প্রতিবেদন-ডকুমেন্টেশন ও মূল্যায়ন কর্মকর্তা প্রদীপ মার্ডি। এতে প্রান্তিক চাষিদের পানিসংকটের চিত্র তুলে ধরে বলা হয়, বরেন্দ্র অঞ্চলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ৮৭ শতাংশ পরিবার ভূমিহীন, যাদের সবাই ভাগচাষি। এ ছাড়া ১০ শতাংশ পরিবার নিজ জমিতে চাষাবাদ করে। তারা বিভিন্ন সংকটের মধ্যে দুর্বিষহ জীবন যাপন করে। বরেন্দ্রের প্রায় ৪ লাখ কৃষক অপারেটরদের কাছে জিম্মি হয়ে আছেন। অপারেটররা একটি পানি মাফিয়াতন্ত্র কায়েম করেছেন। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর কোনো চাষির ১০ বিঘা জমি থাকলে দুই বিঘা জোর করে বর্গা চাষের জন্য কেড়ে নেওয়া হয়। স্বার্থান্বেষী এই মহল বরেন্দ্র অঞ্চলের পানি সেচের নামে একটি শোষণযন্ত্র চালায়।

পরে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর চাষিরা বিভিন্ন অভিযোগ তুলে ধরেন। গোদাগাড়ীর বর্ষাপাড়া গ্রামের আনন্দ বলেন, পানির অভাবে তাঁর ১০ কাঠা জমি এখনো পড়ে আছে। শাহানাপাড়া গ্রামের ঝরনা লাকড়া বলেন, চাষের আগেই অপারেটর টাকা চান, গভীর রাতে পানি নিতে ডাকা হয়। অপারেটর বলেন, ‘হাঁস খাওয়াও, মুরগি খাওয়াও।’ রাজি না হলে বলেন, ‘নেশা করে এসেছে।’ গভীর নলকূপ অপারেটর হিসেবে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর লোকজনকেও রাখতে হবে।

পবা উপজেলার হরিপুর গ্রামের আতাউর রহমান বলেন, সব গভীর নলকূপের কমিটি নেই। যাঁরা আছেন, তাঁরা অপারেটরের কাছে বিক্রি হয়ে গেছেন। পানি দেওয়ার জন্য কোনো রেজিস্ট্রার খাতা ব্যবহার করা হয় না। বিএমডিএর কর্মকর্তারাও অপারেটরের কাছেই বিক্রি হয়ে গেছেন। তাঁদের কাছে অভিযোগ করে কোনো ফল হয় না। ডাকলেও সময়মতো যান না।

সব অভিযোগ শুনে বিএমডিএর নির্বাহী পরিচালক আবদুর রশীদ বলেন, কয়েক দিন আগেই তিনি খবর পেয়েছিলেন, একজন অপারেটর তিন হাজার টাকা করে রেজিস্ট্রেশন ফি দাবি করেছেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে বরখাস্ত করা হয়েছে। তবে সব অপারেটরই স্বেচ্ছাচারী নন। যাঁরা এ ধরনের অপরাধ করে থাকেন, তাঁদের চিহ্নিত করতে হবে। তদন্ত করে প্রমাণ পেলে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

মতবিনিময় সভায় গভীর নলকূপের অপারেটর হাসেম আলী বলেন, সেচযন্ত্র নষ্ট হলে যে খরচ হয়, সেটা বিএমডিএ থেকে দেওয়া হলে তাঁদের এই অপবাদ শুনতে হতো না। আরেক অপারেটর মতিউর রহমান বলেন, কেউ কেউ এ ধরনের কাজ করে অতিরিক্ত অর্থ কৃষকদের কাছ থেকে আদায় করেন। তবে সবাই এই কাজ করেন না।

অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি বেগম আখতার জাহান বলেন গভীর নলকূপের অপারেটরদের অনিয়ম আগে মনিটরিং করা হয়নি। এখন থেকে এই মনিটরিং জোরদার করা হবে। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর প্রান্তিক চাষিরা যাতে নির্যাতিত ও বঞ্চিত না হন, সে জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেওয়া হবে।