জুলাই আন্দোলনে ‘সহিংসতায় জড়িত’ ৭৯ শিক্ষার্থীর শাস্তি, আছেন শিবির নেতাও

হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসফাইল ছবি

দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (হাবিপ্রবি) বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সহিংসতার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে সনদ বাতিল ও আজীবন বহিষ্কারসহ ৭৯ শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তির সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রশাসন। তালিকায় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীর পাশাপাশি শাখা ছাত্রশিবিরের এক নেতার নামও রয়েছে। এরই মধ্যে বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা আলোচনা–সমালোচনা চলছে।

বিশ্ববিদ্যালয় রেজিস্ট্রার স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে গত মঙ্গলবার বিষয়টি জানানো হয়। আদেশে বলা হয়, বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শাখা ছাত্রলীগের সহিংসতার ঘটনাগুলো ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটির মাধ্যমে তদন্ত করে জড়িত শিক্ষার্থীদের অপরাধের ধরন বিবেচনায় দুই ক্যাটাগরিতে তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসন ও শৃঙ্খলা বোর্ডের ২২তম সভায় তা উপস্থাপন করা হয়। শাস্তি প্রদানে গৃহীত সিদ্ধান্ত ও সুপারিশমালা অনুমোদনে গত ২৯ মে রিজেন্ট বোর্ডের ৫৯তম সভায় উপস্থাপন করলে বোর্ড অভিযুক্ত শিক্ষার্থীদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিয়ে প্রস্তাবিত শাস্তি সাময়িকভাবে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

প্রকাশিত তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ৭৯ জনের মধ্যে ২৭ জন শাখা ছাত্রলীগের বিভিন্ন পদধারী নেতা। ছাত্রশিবিরের একজন পদধারী নেতা, অন্যরা ছাত্রলীগের কর্মী ও সাধারণ শিক্ষার্থী। শাস্তি পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে চারজন বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত। তালিকায় থাকা শিক্ষার্থীরা ১৪ থেকে ২২তম ব্যাচের। যাঁদের অধিকাংশই স্নাতক সম্পন্ন করেছেন। ৭৯ জনের মধ্যে ‘এ’ ক্যাটাগরিতে আছেন ৪১ জন। তাঁদের বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সশস্ত্র হামলা, মারধর, অস্ত্র হাতে দেখা, অস্ত্র সরবরাহ, কক্ষে অস্ত্র পাওয়া ও সশস্ত্র মিছিলে অংশ নেওয়ার অভিযোগে শাস্তি হিসেবে সনদ বাতিল, সনদ স্থগিত, আজীবন বহিষ্কার ও রাষ্ট্রীয় আইনে মামলার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যদিকে ‘বি’ ক্যাটাগরিতে আছেন ৩৮ জন। তাঁদের বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের বিরোধিতা করা ও মিছিলে অংশগ্রহণ করার অভিযোগে দুই থেকে তিন বছরের জন্য বহিষ্কারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

আজ বৃহস্পতিবার তালিকাভুক্ত ব্যক্তিদের কাছে লিখিত নোটিশ পাঠানোর কাজ শুরু করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। নোটিশের জবাবের ওপর পরবর্তী সময় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন রিজেন্ট বোর্ডের সভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবে। তবে আপাতত তালিকাভুক্ত শিক্ষার্থীদের সাময়িকভাবে বহিষ্কার ও ডিগ্রি পাওয়া শিক্ষার্থীদের সনদ স্থগিত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তালিকা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনা শুরু হয়েছে। প্রশাসনের দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটি ফেসবুক গ্রুপে (এইচএসএ) রাসেল সরকার নামের এক শিক্ষার্থী লিখেছেন, ‘ঢাকায় মোহাম্মদপুরে আন্দোলন করলাম স্বৈরাচারকে হটানোর জন্য। পুলিশ ধরাধরি শুরু করলে দিনাজপুরে আন্দোলনে সশরীরে যোগ দিলাম। আজ শাস্তিপ্রাপ্তদের তালিকায় নিজের নাম দেখতেছি। এই লজ্জা শুধু আমার না, জুলাইয়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন করেছিল সবার জন্য লজ্জা।’

সুজন সরকার নামের এক শিক্ষার্থী মন্তব্যের ঘরে লিখেছেন, ‘২০২৩ সালের পর থেকে কাজের চাপে কখনোই ভার্সিটিতে যাওয়ার সুযোগ পাই নাই। কোনো দলের সাথে তো দূরের কথা; ক্লাসের কোনো গ্রুপিংয়ে আমি ইনভলব (যুক্ত) ছিলাম না। কিন্তু তালিকায় আমার নাম দেখে আকাশ থেকে পড়ে গেছি। এখন আমার করণীয় কী, দয়া করে বলবেন।’

তালিকায় ক্যাটাগরি–১–এ ৩৬ নম্বরে রয়েছে আরিফ হোসেনের নাম। এই ক্যাটাগরির শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে সনদ বাতিল, সনদ স্থগিত ও আজীবন বহিষ্কার। আরিফ কৃষি অনুষদের ২০তম ব্যাচের শিক্ষার্থী। তিনি শাখা ছাত্রশিবিরের দাওয়াহ সম্পাদক।

জানতে চাইলে শাখা ছাত্রশিবিরের সভাপতি রেজওয়ানুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘ফ্যাসিবাদী সরকারের বিরোধিতা করায় ২০২৩ সালে আরিফকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। জেলও খেটেছেন। জুলাইয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। তালিকায় তাঁর নাম থাকাটা দুঃখজনক।’ তিনি বলেন, ‘রিজেন্ট বোর্ডে ১০২ জনের তালিকা উপস্থাপন করা হয়েছিল। এক বছর পরে হয়ে গেছে ৭৯ জন। এক বছরেও প্রশাসন তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি। এতে প্রশাসন অদক্ষতা ও অযোগ্যতার প্রমাণ দেয়। বিষয়টি নিয়ে প্রশাসনের কাছে প্রশ্ন তুলেছি। কিন্তু তারা কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি।’

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় রেজিস্ট্রার প্রফেসর আবু হাসান বলেন, ‘বিভিন্ন তথ্য–প্রমাণের ভিত্তিতে ৭৯ জনের একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। আগামীকাল শুক্রবার থেকে তাঁদের কাছে লিখিত নোটিশ যাবে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে জবাব দেবেন। সন্তোষজনক না হলে অফিস আদেশে শাস্তির বিধান অব্যাহত থাকবে।’