এক রাতে ‘গায়েব’ সরকারি এক পাকা ভবন

এক রাতের মধ্যে জামালপুর সদর উপজেলার কেন্দুয়া ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের একটি আস্ত পাকা ভবন ‘গায়েব’ হয়ে গেছে। ভবনের জায়গায় এখন ভাঙাচোরা ইট ও আর্বজনা পড়ে আছেছবি: প্রথম আলো

এক রাতের মধ্যে জামালপুর সদর উপজেলার কেন্দুয়া ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রের একটি সরকারি পাকা ভবন ‘গায়েব’ হয়ে যাওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। সরকারি পাকা ভবনটি ‘গায়েব’ হওয়ার অভিযোগ এনে গত শনিবার সদর থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের আবাসিক কর্মকর্তা রিপন রায়।

জিডির বিষয়ে রিপন রায় বলেন, ‘গত বৃহস্পতিবার অফিস শেষ করে চলে আসি। শনিবার আবারও অফিসে গিয়ে দেখি, ভবনটি কে বা কারা ভেঙে নিয়ে গেছেন। পরে আমি বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাই। তাদের নির্দেশে জিডিটি করেছি।’

এক রাতের মধ্যে বড় একটি পাকা ভবন উধাও হওয়ার বিষয়ে আজ সোমবার সকালে স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা হয়। তাঁদের ভাষ্য, কেন্দুয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ও সদর উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম খানের নির্দেশে তাঁর ঘনিষ্ঠ যুবলীগের কর্মী শফিকুল ইসলাম ওরফে সাজু লোকজন নিয়ে ভবনটি ভাঙেন। এক রাতের মধ্যে পুরো ভবনটি ভেঙে নেওয়া হয়। গত শুক্রবার সকালে সেখানে স্থানীয় লোকজন ভবনটিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলেন। কিন্তু পরদিন সকালে ওই জায়গায় কিছু ভাঙাচোরা ইট পড়ে থাকতে দেখেন।

সরেজমিনে দেখা যায়, জামালপুর-সরিষাবাড়ী মহাসড়কের পূর্ব পাশে কেন্দুয়া স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্র এবং পশ্চিম পাশে কেন্দুয়া ইউপি ভবন। দুটি সড়কের এই পাশ আর ওই পাশ। ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রের সামনে কিছু ভাঙাচোরা ইট পড়ে আছে। জায়গাটি দেখেই বোঝা যাচ্ছে, সেখানে একটি ভবন ছিল। কিন্তু এখন কিছুই নেই। ভবনের দক্ষিণ ও উত্তর পাশে কিছু ভাঙাচোরা ইটের আবর্জনা পড়ে আছে। ভবনটি ভাঙতে একটি ভেকু মেশিন ব্যবহার করা হয়েছিল। ইউপি প্রাঙ্গণে একটি ভেকু মেশিন দেখা যায়। ইউপি প্রাঙ্গণে পুরোনো কিছু রডও পড়ে ছিল।

মো. শহিদ আলী নামের মধ্যবয়সী একজন ভাঙাচোরা ইটের ওপর দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি বলেন, ‘ভবন ভাঙাচোরার কাজ করি। চেয়ারম্যান (মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম খান) আমাকে এখানে ভবন ভাঙাচোরার কাজ করার জন্য আসতে বলছিলেন। তাই আসছি।’

ভবনটি ভেঙে নেওয়ার বিষয়ে ওই স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্র ভবনে গিয়ে কাউকে পাওয়া গেল না। একটি কক্ষে ওই কেন্দ্রের ফার্মাসিস্ট মো. জহুরুল ইসলাম কয়েকজন নারীকে ওষুধ দিচ্ছেন। ভবনটি উধাও হওয়ার বিষয়ে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বৃহস্পতিবার বিকেলে ভবন থাকা অবস্থায় আমরা চলে যাই। শনিবার সকালে এসে দেখতে পাই, পরিত্যক্ত ভবনটি নেই। কে বা কারা ভবনটি এক রাতের মধ্যে ভেঙে নিয়ে গেছে। বিষয়টি আমি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাই।’ ভবনটি কে ভেঙেছে, জানতে চাইলে তিনি কোনো কথা বলতে রাজি হননি।

ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রের কাছাকাছি এলাকার এক দম্পতি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, শুক্রবার দুপুরে হঠাৎ চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ঠ শফিকুল ইসলাম ওরফে সাজু ভেকু মেশিন ও লোকজন নিয়ে ভবনটি ভাঙতে শুরু করেন। প্রায় ৫০ বছর ধরে তাঁরা ভবনটি সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছেন। হঠাৎ ভবনটি ভাঙা শুরু হলে তাঁদের ছেলে ভিডিও ধারণ করতে যান। তখন শফিকুল তাঁদের ছেলেকে মারতে উদ্ধত হয়ে মুঠোফোন কেড়ে নেন।

ভবনের জায়গায় এখন ভাঙাচোরা ইট ও আর্বজনা পড়ে আছে
ছবি: প্রথম আলো

অভিযোগের বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে শফিকুল ইসলাম নিজেকে যুবলীগের কর্মী হিসেবে পরিচয় দিয়ে বলেন, ‘চেয়ারম্যান আমার এলাকার চাচা। সেই হিসেবে তাঁর সঙ্গে পরিচয় আছে। ওই ভবন আমি ভাঙিনি। তবে শুক্রবার বিকেলে আমি ভবনটি ভাঙার তামাশা দেখতে গিয়েছিলাম। সেখানে দাঁড়িয়ে সবার মতো আমিও তামাশা দেখেছি। তাই স্থানীয় লোকজন সেখানে আমাকে দেখেছেন। ভবনটি মাদকসেবীদের আখড়ায় পরিণত হয়েছিল। ভবন ভাঙার কোনো সম্পদ কেউ আত্মসাৎ করেনি। সেগুলো সেখানেই আছে।’

এ বিষয়ে কেন্দুয়া ইউপি চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম খান মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘শফিকুল ইসলাম আমার ভাতিজা। আমি ওই ভবন ভাঙা সম্পর্কে কিছুই জানি না। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে আমি বিষয়টি শুনেছি। পরে কিছু রড ইউপি প্রাঙ্গণে রেখেছি, যাতে চুরি না হয়।’ তাঁর নির্দেশেই ভবনটি ভাঙা হয়েছে, এমন অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘স্থানীয় লোকজন যা বলবেন, আপনারা সেটাই বিশ্বাস করবেন? সেই দিন তো আমি এলাকায় ছিলাম না।’ ইউপি প্রাঙ্গণে এক্সকাভেটরের উপস্থিতি সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘সেটাই যে ওই ভেকু, আপনি কীভাবে বুঝলেন?’

জামালপুর সদর উপজেলার স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা উত্তম কুমার সরকার বলেন, ‘পুলিশ তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। ভবনের যেটুকু অবশিষ্ট আছে, সেটুকুর জন্য আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।’ তিনি জানান, ২০২২ সালে টেন্ডারের মাধ্যমে এ ভবনটি ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু একটি পক্ষের মামলার কারণে আইনি জটিলতায় ভবনটি আর ভাঙা যায়নি। ভবনটি ওই অবস্থায় পড়ে ছিল।

জামালপুর সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুহাম্মদ মহব্বত কবীর বলেন, ভবনটি ভেঙে নেওয়ার বিষয়ে একটি জিডি হয়েছে। কে বা কারা ভবনটি ভেঙে নিয়েছেন, সে বিষয়ে তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।