রবীন্দ্রনাথের পরামর্শে গড়া যে লাইব্রেরি

নাটোরের ভিক্টোরিয়া পাবলিক লাইব্রেরিতে পড়াশোনায় মগ্ন পাঠকেরা
ছবি: প্রথম আলো

নাটোরের মহারাজা জগদিন্দ্রনাথ রায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের খুবই প্রিয়ভাজন ছিলেন। কবি তাঁকে ‘রাজন’ বলে ডাকতেন। তাঁর আমন্ত্রণে কবিগুরু নাটোরে আসেন ১৮৯৮ সালে। সে সময় কবিগুরু বলেছিলেন, ‘রাজন, আপনার নাটোরে একটি পাবলিক লাইব্রেরি থাকা প্রয়োজন।’ তাঁর এই অনুপ্রেরণায় মহারাজার হাত ধরে ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে নাটোরে গড়ে ওঠে ‘ভিক্টোরিয়া পাবলিক লাইব্রেরি’, যা আজ এ দেশের অন্যতম প্রাচীন গণগ্রন্থাগার।

ভিক্টোরিয়া পাবলিক লাইব্রেরির আজীবন সদস্য ও গ্রন্থাগার সংগঠক শেখ মো. বাজলুল কামালের এক লেখা থেকে জানা যায়, মহারাজা পাঠাগার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাথমিকভাবে পাঁচ শতক জমি, বেশ কিছু মূল্যবান গ্রন্থ, একটি ঘড়ি ও এককালীন অর্থসহায়তা দিয়েছিলেন। পাঠাগারের গ্রন্থ নির্বাচনের দায়িত্ব পড়েছিল মহারাজার দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু প্রখ্যাত ঐতিহাসিক অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় এবং ভারতবর্ষ পত্রিকার সম্পাদক জলধর সেনের ওপর।

প্রথমে শহরের লালবাজারে প্রতিষ্ঠিত হলেও পরে পাঠাগারটি কাফুরিয়াপট্টির বর্তমান স্থানে স্থানান্তরিত হয়। সে সময় পাঠাগারের উন্নতি ত্বরান্বিত হয় চিকিৎসক নলিনীকান্ত সাহা, নিরঞ্জন কুমার সাহা, সুবীর চন্দ্র রায়, নরেন্দ্রনাথ লাহিড়ী ও শিক্ষাবিদ শীতেন্দ্র মোহনের হাত ধরে।

১৯৩৯-৪০ সালে পাঠাগারটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ কাজী আবুল মসউদ। পরেরবার সাধারণ সম্পাদক হন তাঁর বন্ধু আইনজীবী গোবিন্দ সাহা। গোবিন্দ সাহার সঙ্গে দেখা করে তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন প্রবন্ধকার বাজলুল কামাল। তিনি গোবিন্দ সাহার বরাত দিয়ে প্রথম আলোকে জানান, পরিচালনা পর্ষদের উৎসাহে পাঠাগারে ‘পূর্ণিমা সম্মিলনী’ নামে সাহিত্য আসর চালু হয়। প্রতি পূর্ণিমায় এ আসর বসত।

আসর মুখর হতো মনোজ্ঞ সাহিত্য আলোচনায়। উৎসবে দেশব্যাপী সাহিত্যিকদের আমন্ত্রণ জানিয়ে অনুষ্ঠিত হতো সাহিত্য সম্মেলন। এসব সাহিত্য সম্মেলনে অতিথি হয়ে আসতেন কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, তৎকালীন যুগান্তর পত্রিকার সম্পাদক বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়, আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদক চপলাকান্ত ভট্টাচার্যসহ দেশবরেণ্য ব্যক্তিরা।

মহারাজার দান করা পাঁচ শতক জমিতে আটচালা টিনের ঘরে শুরু হয়েছিল লাইব্রেরির কার্যক্রম, জানালেন পাঠাগারের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক আলতাফ হোসেন। সে সময় রাজপরিবারের পাঠাগার থেকেও কিছু বই ভিক্টোরিয়া পাবলিক লাইব্রেরিতে দান করা হয়। এর মধ্যে দুটি বই এখনো আছে। বই দুটিতে ‘দিঘাপতিয়া রাজ লাইব্রেরী’ সিলমোহর অক্ষত আছে। যদিও এই দুটি ছাড়া পুরোনো প্রায় সব বই স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় লুট হয়ে যায়। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় পাঠাগারটি।

স্বাধীনতার পর সত্তরের দশকে মূলত পাঠাগারের কার্যক্রম একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। তখন শুধু চালু থাকে সংগীত বিভাগ। আশির দশকে পাঠাগারটির পুনর্জন্ম। ১৯৮০ সালে নাটোরের তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক এ এইচ এস সাদেকুল হক ও অধ্যক্ষ শফীউদ্দীন সরদারের পদক্ষেপে পাঠাগারটি গতি ফিরে পায়। ১৯৮৬ সালে সভাপতি হন তৎকালীন জেলা প্রশাসক জালাল উদ্দিন আহামেদ। তাঁর প্রচেষ্টায় পাঠাগারের কাঠামোগত উন্নয়ন হয়।

বর্তমানে গ্রন্থাগারটি দাঁড়িয়ে আছে নিজস্ব তিনতলা ভবনে। বই রয়েছে সাড়ে ১৪ হাজার। আরও আছে সহস্রাধিক সাপ্তাহিক পত্রিকার পুরোনো কপি। এ ছাড়া দৈনিক পত্রিকা আটটি, সাপ্তাহিক পাঁচটি, পাক্ষিক দুটি পত্রিকা রাখা হয়। পাঠাগার থেকে বনলতা নামে ত্রৈমাসিক দেয়ালপত্রিকা প্রকাশ করা হয়। প্রতিদিন গড়ে ৩০০ পাঠক এখানে বই পড়তে আসেন। বিকেল চারটা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত খোলা থাকে পাঠকক্ষ। সাপ্তাহিক বন্ধ শনিবার।

শিক্ষামূলক কার্যক্রম ছাড়াও পাঠাগারটি মেধা ও মননশীল কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়ে থাকে। ‘রূপসী বাংলা’ নামে পাঠাগারের একটি অঙ্গসংগঠন রয়েছে। এখানে সপ্তাহে দুই দিন শিশু–কিশোরদের বাংলা ভাষার উচ্চারণ, আবৃত্তি, উপস্থাপনা, সাধারণ জ্ঞান ও উপস্থিত বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। এ ছাড়া সাহিত্য সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বাংলা বর্ষবরণ ও জাতীয় দিবস পালনেও রয়েছে অগ্রণী ভূমিকা। কবি জসীমউদ্‌দীন, আল মাহমুদ, হেলাল হাফিজ, অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, রবীন্দ্রগবেষক আহমদ রফিক, লেখক ইমদাদুল হক মিলনসহ খ্যাতিমান মানুষের পদচারণে ধন্য হয়েছে এই পাঠাগার।

পাঠাগারটি পরিচালনার দায়িত্বে আছে ১৫ সদস্যের কার্যনির্বাহী পরিষদ। নিবন্ধিত সদস্য আছেন ১ হাজার ৪৭৫ জন, সহযোগী সদস্য ২২৩ জন ও আজীবন সদস্য ২৮৭ জন।

নাটোরের ঐতিহ্য–সংস্কৃতিকে আরও বিকশিত করতে চায় ভিক্টোরিয়া পাবলিক লাইব্রেরি। সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক ২০১৪ সালের ৮ জুন এই গ্রন্থাগারে এসে সেই প্রত্যাশার কথাই বলে গেছেন। পরিদর্শন খাতায় তিনি লিখে গেছেন, ‘বেসরকারী উদ্যোগে, স্থানীয় গ্রন্থপ্রেমী মানুষেরা এই গ্রন্থাগারটিকে টিকিয়ে রেখেছেন, চালু রেখেছেন এবং সম্প্রসারণের কাজে হাত দিয়েছেন, দেখে আশান্বিত হলাম। বইয়ের বিকল্প নেই। এই গ্রন্থাগার নাটোরবাসীর জ্ঞান ও বুদ্ধিচর্চার ক্ষেত্রে অতীতের মতোই অবদান রেখে চলেছে। এতে আমি আনন্দিত হয়েছি। গ্রন্থাগারটি আরও উজ্জ্বল একটি মননকেন্দ্রে পরিণত হবে—এই আশা করি।’