চরফ্যাশনে সেচপাম্পের দখল নিয়ে বিরোধ-সংঘর্ষ, ১২০ একর জমিতে বোরো আবাদ ব্যাহত

বিএডিসির সেচ পাম্প দখল নিয়ে দুই পক্ষের বিরোধ। খেতে চাষ দিয়েছেন কৃষক। কিন্তু পানির অভাবে বোরো ধানের চারা লাগাতে পারছেন না। রোববার বিকেল ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার এওয়াজপুর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের দক্ষিণ মাদ্রাজ হাওলাদারের বাঁক বিলেছবি: প্রথম আলো

ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার এওয়াজপুর ইউনিয়নে বিএডিসির একটি সেচপাম্পের দখল নিয়ে দুই পক্ষের বিরোধের জেরে  ১২০ একর জমিতে বোরো আবাদ ব্যাহত হচ্ছে। সেচের অভাবে খেত ফেটে চৌচির হয়ে গেছে।

এই সেচপাম্প ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের দক্ষিণ মাদ্রাজ হাওলাদারের বাঁক বিলে। সেচ পাম্পটি কেন্দ্র করে ৫ আগস্টের পরে দুই পক্ষ দুবার মুখোমুখি সংঘর্ষে জড়িয়েছে। সর্বশেষ ১৭ জানুয়ারি তারা সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এ নিয়ে দুই পক্ষই উপজেলার শশীভূষণ থানায় অভিযোগ দিয়েছে।

ওই এলাকায় কর্মরত উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আব্দুর রহিম প্রথম আলোকে বলেন, স্থানীয় দুই পক্ষের বিরোধের জেরে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন সংস্থার (বিএডিসি) সেচপাম্পটি চালু না করার কারণে হাওলাদার বাঁক বিলের প্রায় ৫০ একর জমি অনাবাদি থাকার আশঙ্কা আছে। চাষের উপযুক্ত সময়ে পানির অভাবে কৃষক আবাদ করতে পারছেন না। যাঁরা আবাদ করেছেন, তাঁদের খেত ফেটে যাচ্ছে। অনেকের পুকুর থেকে সেচ নিতে হচ্ছে। বিষয়টি তিনি স্থানীয় বিএনপি নেতা, কৃষি কর্মকর্তা ও প্রশাসনকে জানিয়েছেন। যেভাবে হোক তাঁরা সময়মতো বোরো খেতে সেচ চালুর ব্যবস্থা করবেন।

তবে স্থানীয় কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দক্ষিণ মাদ্রাজ হাওলাদার বিলে সেচ প্রকল্পের ব্যবস্থাপক  শওকত হোসেন হাওলাদার ও শশীভূষণ থানা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক আমিনুল একরাম জাহাঙ্গীরের মধ্যে জমিজমা নিয়ে বিরোধ আছে। ওই বিলে দুটি পাম্পের মাধ্যমে ১২০ একর জমিতে সেচ দেওয়া হয়। দুটি পাম্পেরই নিয়ন্ত্রণ শওকতের কাছে। এই দুই ব্যক্তির বিরোধের জেরে পাম্পের ঘরে তালা ঝোলান আমিনুল একরাম পক্ষের লোকজন। পরে ওই তালার ওপর শওকত হোসেন আরেকটি তালা লাগান। পাম্প বন্ধ থাকায় সেখানকার কৃষকেরা এই শুষ্ক মৌসুমে জমিতে চাষ দিয়ে, সার ছিটিয়ে বসে আছেন। পানির অভাবে খেতে চারা লাগাতে পারছেন না। খেত শুকিয়ে যাচ্ছে। যাদের সুযোগ আছে, তাঁরা পাশের পুকুরের পানি কিনে বোরো খেতে সেচ দিচ্ছেন। যাঁরা দিতে পারেননি, তাঁদের অনেকের বোরো খেতে ফাটল দেখা দিয়েছে।

অনেকে বোরোখেতে ধান লাগিয়ে বিপাকে পড়েছেন। পানির অভাবে ধান খেত ফেটে চৌচির
ছবি: প্রথম আলো

হাওলাদার বিলের বোরো কৃষক মো. শাহে আলম জানান, তিনি অনেক বছর ধরে এক কানি জমিতে বোরো আবাদ করে আসছেন। তিনি এবারও পুরো জমিতে চাষ দিয়ে রেখেছেন। এর মধ্যে ৪০ শতাংশ নিচু জলাভূমিতে ইতিমধ্যে বোরোর চারা লাগিয়েছেন। বাকি ১২০ শতাংশ জমিতে পানির অভাবে আবাদ করতে পারছেন না। যেটুকুতে আবাদ করেছেন, সেই ধানের খেতে পানির সংকট দেখা দিলে, বাধ্য হয়ে শাহে আলম একটি পুকুর থেকে পানি কিনে সেচ দিচ্ছেন।

শাহে আলমের মতো মো. হানিফ, মো. আলাউদ্দিন, সেলিম ডুবাই, কামরুল ইসলাম, বাবুল শিকদারসহ ওই বিলের শতাধিক কৃষক সেচ–সংকটে চরম ভোগান্তির কথা জানান।

সেচপাম্পে তালা ঝুলিয়ে দেওয়ার বিষয়ে আমিনুল একরাম জাহাঙ্গীর ও শওকত হোসেন হাওলাদারের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁরা দুজনই পরস্পরের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ এনেছেন।

বিএনপি নেতা আমিনুল একরাম জাহাঙ্গীর বলেন, বিলের প্রায় ১২ একর জমির মালিক তিনি। আওয়ামী লীগের সময় ক্ষমতার দাপটে সেচ প্রকল্পের ব্যবস্থাপক শওকত হোসেন তাঁর মালিকানাধীন প্রায় ৫০ শতাংশ জমি দখল করে রেখেছিলেন। এসব জমি তিনি শওকতের বাবা আবু তাহের হাওলাদারের কাছ থেকে কিনেছিলেন। ওই জমিতে জোরপূর্বক বিএডিসির পাকা ঘর ও সেচপাম্প বসিয়েছেন শওকত। তখন তিনি বিএডিসিকে লিখিত অভিযোগ দিলেও সেটি উপেক্ষা করা হয়। শওকত তাঁর একটি মাছের পুকুর জোর করে ভোগ-দখল করছেন। তিনি কৃষকদের কাছ থেকে ইচ্ছেমতো টাকা আদায় করলেও ঠিকমতো পানি দেননি। এ কারণে ক্ষুব্ধ কৃষকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে কৃষক দলের সভাপতি আবদুল মান্নান ১৭ জানুয়ারি সেচ প্রকল্পের ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব থেকে শওকতকে সরিয়ে খোরশেদ আলমকে দায়িত্ব দেওয়ার জন্য পাম্পঘরের সামনে একটি সালিস ডাকেন। সেচপাম্পের ঘরের তালা খুলে সেখানে বসতে গেলে শওকত হাওলাদার স্থানীয় নারীদের নেতৃত্বে একটি ঝাড়ুমিছিল বের করে তাঁদের ওপর হামলা করেন। এ সময় খোরশেদ আলমকে পিটিয়ে জখম করা হয়। তিনি এখন চরফ্যাশন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন।

সেচের পানির অভাবে  বিলের ১২০ একর জমিতে বোরো আবাদ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে
ছবি: প্রথম আলো

অন্যদিকে সেচ প্রকল্পের ব্যবস্থাপক মো. শওকত হোসেন হাওলাদার বলেন, বিএনপি নেতা আমিনুল একরাম তাঁর বাবার কাছ থেকে প্রায় ৮ একর ৮০ শতাংশ জমি কিনেছিলেন। ওই জমির কিছু সরকারি রাস্তার মধ্যে চলে গেছে। কিন্তু আমিনুলের দাবি ওই জমি তিনি (শওকত) ভোগদখল করছেন। এ নিয়ে বিরোধের জের ধরে ৫ আগস্টের পরে আমিনুল একরামের নির্দেশে ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা তাঁর (শওকত) কাছে তিন লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন। টাকা না দিলে পাম্প কক্ষে তালা ঝুলিয়ে দেন। পরে তিনি আরেকটি তালা ঝোলান। ১৭ জানুয়ারি সকালে সেচপাম্পের ঘরের তালা ভাঙলে গ্রামের নারীরা ঝাড়ুমিছিল বের করলে আমিনুলের লোকজন হামলা চালান। তখন তিন নারী আহত হন। তাঁরাও হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন।

কেন পাম্প চালু করা হচ্ছে না জানতে চাইলে চরফ্যাশন বিএডিসির উপসহকারী প্রকৌশলী আরিফ হোসেন জানান, তাঁদের নিয়োগ করা সেচ ব্যবস্থাপক শওকত হোসেনের কাছে একটি পক্ষ চাঁদা দাবি করেছে বলে শুনেছেন তিনি। এ কারণে পাম্প বন্ধ করে রেখেছেন। তিনি শওকত হোসেনকে বিষয়টি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে লিখিতভাবে জানাতে বলেছেন।