রাজশাহীর ছয় গ্রামে ষষ্ঠীর আগেই বিসর্জনের বিরহ
মন্দিরে তেমন কেউ নেই। শুধু পুরোহিত আর নাপিত দুজন সহযোগী নিয়ে সপ্তমীর ঘট স্থাপন করছেন। ১৭ হাজার টাকা পারিশ্রমিকে ছয় দিনের জন্য নওগাঁর মান্দা থেকে এসেছেন ঢুলি শ্যামল চন্দ্র পাল ও দীপক চন্দ্র পাল। তাঁরা ঢাক নিয়ে বসে আছেন। ঢাকে কাঠি পড়ছে না।
রাজশাহীর গোদাগাড়ীর প্রেমতলী দুর্গামাতা ও কালীমাতা মন্দিরে আজ সোমবার সকালে এ দৃশ্য দেখা যায়। প্রেমতলীর মতো গোদাগাড়ীর ছয় গ্রামে মহাষষ্ঠীর আগেই বিসর্জনের বেদনায় বিমর্ষ হয়ে পড়েছেন পূজারিরা। গত শনিবার বাধ্যর্কজনিত রোগে মারা যাওয়া একজনকে দাফন করতে গিয়ে নৌকাডুবিতে তিনজনের মৃত্যুতে ছয় গ্রামের শারদীয় উৎসব শুধু নিয়ম রক্ষার আয়োজনে পরিণত হয়েছে, যেন তাদের জীবনে উৎসব আসেনি।
রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার প্রেমতলী, খেতুর, ডুমুরিয়া, পালপাড়া, কাঁঠালবাড়িয়া ও ফরাদপুর গ্রামে এবার দুর্গাপূজার উৎসব আসেনি। এসব গ্রামের হিন্দু-মুসলমান সবাই শোকাহত। এবার মহাষষ্ঠীর দিনেই প্রেমতলী দুর্গামাতা ও কালীমাতা মন্দিরে দেবী দুর্গার আগমন ঘটেছে বটে, তবে উৎসবের সাড়া পড়েনি।
প্রেমতলী এলাকায় প্রতিবছর বেশ জাঁকজমকপূর্ণভাবেই শারদীয় দুর্গোৎসব উদ্যাপিত হয়। প্রেমতলী খেতুরেই শ্রীশ্রী নরোত্তম দাস ঠাকুরের খেতুরীধাম। এলাকাটি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে তীর্থভূমি। প্রতিবছর দুর্গাপূজার পরই খেতুরীধামে নরোত্তম দাসের তিরোভাব তিথি অনুষ্ঠানে দেশ-বিদেশ থেকে আসেন কয়েক লাখ মানুষ।
স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, শনিবার সকালে প্রেমতলী পালপাড়া এলাকার কানাই কর্মকার (৭০) নামে এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়। এর আগের দিন একই এলাকার গৃহবধূ প্রমিলা সাহা জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। কানাই কর্মকারের মরদেহ সৎকার করতে পদ্মা নদীর মাঝচরে নেওয়া হয়। প্রায় ২০ বছর আগে জেগে ওঠা এই চরেই এলাকার হিন্দুদের সমাধি দেওয়া হয়। মরদেহটি চরে রেখে আরও আত্মীয়স্বজনকে নিতে একটি নৌকা আসে। এতে ২০ থেকে ২৫ জন নৌকায় উঠে নদী পার হয়ে চরে যাচ্ছিলেন। তখন স্রোতের তোড়ে নৌকাটি ডুবে যায়। কিছুক্ষণ পরই জিতেন মণ্ডল নামের একজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। পরদিন ভেসে ওঠে দীলিপ দাস ও হরেন সাহার মরদেহ। সবার বাড়ি কাছাকাছি দূরত্বে। তাঁদের মৃত্যুতে পুরো এলাকাজুড়ে শোক।
আজ সোমবার সকালে প্রেমতলী দুর্গামাতা ও কালীমাতা মন্দিরে গিয়ে দেখা যায়, ঢাকে কাঠি পড়ছে না। শুধু পূজার সময় ঢাক বাজানো হবে বলে জানান পূজারিরা। মন্দিরের নিরাপত্তায় ছিলেন কয়েকজন আনসার সদস্য। ইসমাইল হোসেনের সঙ্গে কথা হয়। তাঁর নিজের উৎসব না হলেও তিনিও পুজারিদের ব্যথায় ব্যথিত। ইসমাইল বললেন, এতগুলো মানুষের মৃত্যুর পর আসলে উৎসব থাকে না। তাই কারও মনে কোনো আনন্দ নেই।
মন্দির কমিটির তথ্য ও প্রযুক্তি সম্পাদক অর্ক কুমার পাল বললেন, ১৯৮৭ সাল থেকে এখানে পূজা হয়। এ রকম করুণ পূজা আগে কখনো আসেনি। এবার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, গান-বাজনা কিছুই হবে না।
মন্দির কমিটির সভাপতি মোহন কুমার পাল জানান, আশপাশের গ্রামগুলো থেকে শতাধিক হিন্দু পরিবার এখানে পূজা করে। এবার পুরো সমাজে শোকের ছায়া। তাই মহাষষ্ঠীর দিনে জনা দশেক নারী-পুরুষ এসেছিলেন। আগের বছরগুলোয় শতাধিক নারী-পুরুষ এসেছেন। এবার সপ্তমীর সকালে তো শুধু পুরোহিত আর নাপিত ঘট স্থাপন করলেন। বাইরে থেকে একজনও আসেননি। প্যান্ডেলে বসারও কেউ নেই।
মোহন কুমার বলেন, এলাকায় অনেক হিন্দু পরিবার থাকলেও মরদেহ সমাহিত করার জন্য তাঁদের কোনো জায়গা নেই। নদীর মাঝখানে জেগে ওঠা একটা চরকেই তাঁরা প্রায় ২০ বছর ধরে সমাধিস্থল হিসেবে ব্যবহার করছেন। নদীর ভেতর সমাহিত না করা হলে এ রকম মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটত না বলে মনে করেন মোহন কুমার।
রাজকুমারী পালের বাড়ি মন্দিরের সামনে। নিজের বাড়ির বৈঠকঘরে মাটির তৈরি জিনিসপত্র বিক্রি করেন। তাঁর কোনো বিক্রি নেই। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘একই এলাকায় পাঁচ–পাঁচটা লাশ দাফনের পর কি আর আনন্দ থাকে? এবার শুধু পূজা করতে হবে বলে করা। আর কিছুই না। কবরস্থানটা নদীর এপারে থাকলে এই দুর্ঘটনা ঘটত না।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফয়সাল আহমেদ জানান, হিন্দু সম্প্রদায়ের সমাহিত করার স্থানটা গ্রামের ভেতরে করার বিষয়ে তিনি ভাবছেন। এ জন্য গ্রামবাসীকে একটা আবেদন জমা দিতে বলেছেন।