নির্বাচনের জেরে একের পর এক সহিংসতা

গাজীপুর জেলার মানচিত্র

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গাজীপুর-৫ নির্বাচনী এলাকায় আওয়ামী লীগের তৃণমূলে কোন্দল ও সংঘাত থামছে না। গত ৪৩ দিনে আসনটিতে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ২৭টি সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে। এতে আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক ব্যক্তি। প্রায় সব কটি ঘটনাই ঘটেছে নৌকার প্রার্থী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে। ওই আসনে এখনো বিরাজ করছে নির্বাচনী উত্তেজনা।

গাজীপুর-৫ আসন গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলা ও গাজীপুর মহানগরের একাংশ নিয়ে গঠিত। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসনে নৌকা প্রতীকে প্রার্থী হয়েছিলেন মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মেহের আফরোজ (চুমকি)। তাঁকে হারিয়ে নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে (ট্রাক প্রতীক) গাজীপুর জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মো. আখতারউজ্জামান।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর থেকে ১৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নৌকা ও ট্রাক প্রতীকের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে ২৭টি সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনার মধ্যে রয়েছে বাড়ি ও দোকানপাটে হামলা, মারধর, চাঁদা দাবি, দলীয় কার্যালয় ভাঙচুর, অস্ত্রের মহড়া, হুমকি ও অগ্নিসংযোগ। এসব ঘটনায় কালীগঞ্জ থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) পড়েছে ১৫টির বেশি। তবে এর মধ্যে মামলা হয়েছে ৯টি। এসব মামলায় আসামি হন ৩৩৩ জন।

গাজীপুর জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার উখিংমে বলেন, ‘সব কটি ঘটনাই তদন্ত করে দেখছি। অনেক সময় সাধারণ কোনো ঘটনাকেও পলিটিক্যাল ইস্যু বানানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। আমরা সত্য–মিথ্যা যাচাই করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছি।’

কিছু সংঘাতের ঘটনা

১২ ফেব্রুয়ারি বিকেলে কালীগঞ্জের নাগরী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অলিউল ইসলামের ভাই আলিউল ইসলামের প্রাইভেট কারে বরকাউ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে ট্রাক প্রতীকের কয়েকজন সমর্থক হামলা চালান। একই দিন রাত আটটার দিকে অলিউলের বাড়িতেও হামলা চালানো হয়। পরদিন ৪৬ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত ৫০ থেকে ৬০ জনকে আসামি করে কালীগঞ্জ থানায় মামলা করেন আলিউল।

এদিকে চেয়ারম্যান অলিউল ও তাঁর ভাই আলিউলের বিরুদ্ধে পাল্টাহামলা ও মারধরের অভিযোগ তুলে ১৩ ফেব্রুয়ারি কালীগঞ্জ থানায় মামলা করেছেন মোফাজ্জল হোসেন নামের সংসদ সদস্য আখতারউজ্জামানের এক সমর্থক। এজাহারে বলা হয়, ১২ ফেব্রুয়ারি মাগরিবের নামাজের পর নাগরী ইউনিয়নের হরদি বাজারে বাদী ও তাঁর ভাই মাসুদ মিয়ার ওপর হঠাৎ হামলা চালায় অলিউল ও আলিউলের লোকজন। এ সময় মারধরের পাশাপাশি বাদী ও তাঁর ভাইয়ের কাছে থাকা মুঠোফোন ও টাকা ছিনিয়ে নেয়। মামলায় নৌকার প্রার্থীর ৬৮ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত ২০ থেকে ২৫ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।

এ ছাড়া ১৬ ফেব্রুয়ারি উপজেলার বতুলটেক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এলাকায় নৌকার এক সমর্থককে মারধর, ৮ ফেব্রুয়ারি নাগরী ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতাকে মারধর, ৫ ফেব্রুয়ারি শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে নৌকা ও ট্রাক সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ, ১৫ ফেব্রুয়ারি নাগরী বাজারে ট্রাক সমর্থকের মুদিদোকানে হামলার খবর পাওয়া গেছে।

অনেকে বাড়িছাড়া

গত শুক্র ও শনিবার উপজেলার বরকাউ, পাঞ্জুরা, রাথুরা, মুক্তারপুর, নোয়াপাড়া, জামালপুর, চুপাইর, দালানবাজার, চান্দেরবাগ, কালীগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড, শীতলক্ষ্যার খেয়াঘাটসহ অন্তত ১৫টি এলাকায় সরেজমিন কথা হয় স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা ও নেতা–কর্মীদের সঙ্গে। তাঁরা জানান নির্বাচনকে কেন্দ্র করে স্থানীয় আওয়ামী লীগ দুই ভাগ হয়ে যায়। নির্বাচনে আখতারউজ্জামান জয়ী হলে তাঁর লোকজন মেহের আফরোজের লোকজনের ওপর চড়াও হয়। মারধর করে।

এর মধ্যে খবর আসে সংরক্ষিত নারী আসনে সংসদ সদস্য হতে যাচ্ছেন মেহের আফরোজ। এরপর থেকে শক্তিশালী হয়ে ওঠে মেহের আফরোজ চুমকির লোকজন। তাঁরা এখন পাল্টা চড়াও হচ্ছেন আখতারুজ্জামনের লোকজনের ওপর। এসব নিয়ে এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করছে। দুই পক্ষের অনেক নেতা–কর্মী বাড়িছাড়া।

এসব বিষয়ে জানতে মেহের আফরোজের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ধরেননি। কথা বলতে চেয়ে খুদে বার্তা পাঠালেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

সংসদ সদস্য মো. আখতারউজ্জামান বলেন, ‘উনি (মেহের আফরোজ) দীর্ঘ ১৫ বছরে অনেক নেতা–কর্মীকে বঞ্চিত করেছেন। এখন কোনো সংঘাত ঘটে থাকলে সেটা আগের ক্ষোভ থেকে হতে পারে। আমার কোনো গ্রুপ নেই।’