লিবিয়া থেকে এল একজনের মৃত্যুর খবর, উৎকণ্ঠায় আরও ১৩ নিখোঁজ তরুণের পরিবার

লিবিয়ার উপকূলে ছেলের লাশ উদ্ধারের খবরে মা পরিষ্কার বেগমের আহাজারি। গতকাল নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার বড়চর এলাকায়
ছবি: সংগৃহীত

লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার পথে স্পিডবোট ডুবে নরসিংদীর এক যুবকের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। গত বৃহস্পতিবার লিবিয়ার উপকূল থেকে মো. আবদুল নবী (৩০) নামের ওই যুবকের লাশ উদ্ধারের খবর পায় পরিবার। এর পর থেকেই একে একে পাওয়া যাচ্ছে তাঁর সঙ্গে থাকা নরসিংদীর আরও ১৩ তরুণ-যুবকের নিখোঁজের তথ্য।

আবদুল নবী নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার উত্তর বাখরনগর ইউনিয়নের বড়চর এলাকার মৃত হজরত আলীর ছেলে। তাঁর বড় ভাই মো. মাহে আলম মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, বৃহস্পতিবার লিবিয়ার উপকূলে আবদুল নবীর লাশ উদ্ধার করে স্থানীয় কোস্টগার্ড। তাঁর পকেট থেকে উদ্ধার করা হয় বাংলাদেশের পাসপোর্ট। লাশ হাসপাতালের মর্গে নেওয়ার পর সেখানে কর্মরত এক বাংলাদেশি শ্রমিকের সহায়তায় পাসপোর্টে থাকা মাহে আলমের মুঠোফোনে কল দেওয়া হয়। এ সময় লাশ উদ্ধারের ঘটনা জানানোর পাশাপাশি তাঁর পাসপোর্টের ছবিও তুলে পাঠানো হয়।

লিবিয়া উপকূলে আবদুল নবীর লাশ পাওয়ার খবর জানিয়েছেন প্রবাসী এক বাংলাদেশি শ্রমিক
ছবি: সংগৃহীত

পরিবারের সদস্যরা বলছেন, লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার পথে স্পিডবোটডুবির ঘটনায় আবদুল নবীর মৃত্যু হয়েছে। আট ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। এর আগে ৫ বছর সৌদি আরবে কাটিয়েছেন তিনি। দেশে ফিরে লিবিয়াপ্রবাসী এক দালালের খপ্পরে পড়ে আরও ১৩ তরুণ-যুবকের সঙ্গে ৪ মাস আগে ইতালির উদ্দেশে রওনা হন তিনি। ১ মাস ধরে ওই ১৩ জনও নিখোঁজ। তাঁদের খোঁজ পাওয়ার আকুতি স্বজনদের চোখে-মুখে।

লিবিয়াপ্রবাসী ওই দালালের নাম আলম মিয়া। তাঁর বাড়ি নরসিংদীর বেলাব উপজেলার টান লক্ষ্মীপুর গ্রামে। তাঁর বাবার নাম মনা মিয়া। আবদুল নবীর লাশ উদ্ধারের পর থেকেই ওই বাড়িতে নিখোঁজ তরুণ-যুবকদের স্বজন ও স্থানীয় মানুষ ভিড় করছেন, আহাজারি করছেন। মনা মিয়াসহ ওই বাড়ির পুরুষ সদস্যরা পালিয়ে গেছেন। তবে কয়েকজন নারী সদস্য বাড়িটিতে অবস্থান করলেও তাঁরা কোনো প্রশ্নেরই জবাব দিচ্ছেন না। শুধু বলছেন, ওই ১৪ জনের সঙ্গে কী ঘটেছে, তাঁরা জানেন না।

নিখোঁজ ব্যক্তিদের মধ্যে সাতজনের নাম-পরিচয় জানা গেছে। তাঁরা হলেন নরসিংদীর বেলাব উপজেলার নারায়ণপুর ইউনিয়নের টান লক্ষ্মীপুর গ্রামের বিল্লাল মিয়ার ছেলে সৈকত মিয়া (২০), রহিম মিয়ার ছেলে আবু তাহের (২৭), মো. ওবাইদুল্লাহর ছেলে রহমত উল্লাহ (২০) ও চরলক্ষ্মীপুর গ্রামের রতন মিয়ার ছেলে জহিরুল ইসলাম (১৯), আউয়াল মিয়ার ছেলে উজ্জ্বল মিয়া (২০), মোক্তার হোসেনের ছেলে জিহাদ হোসেন (১৯) এবং কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর উপজেলার ছয়সূতি গ্রামের বাছেদ মিয়ার ছেলে স্বপন মিয়া (২৭)। বাকি ছয়জনের নাম-পরিচয় এখনো জানা যায়নি।

আরও পড়ুন

মারা যাওয়া আবদুল নবীর মা পরিষ্কার বেগম, নিখোঁজ রহমত উল্লাহর মা খালেদা বেগম ও স্বপন মিয়ার বাবা বাছেদ মিয়ার সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাঁদের ভাষ্য অনুযায়ী, প্রায় চার মাস আগে লিবিয়াপ্রবাসী দালাল আলম মিয়ার মাধ্যমে ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা চুক্তিতে ইতালি যাওয়ার জন্য মোট ১৪ জন রওনা হন। দুবাই হয়ে তাঁরা লিবিয়ায় পৌঁছান। এর পরের প্রায় তিন মাস নিয়মিত-অনিয়মিতভাবে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল তাঁদের। সর্বশেষ এক মাস আগে গত ২৩ মে লিবিয়ায় থাকাকালে কথা হয়েছিল তাঁদের। তখন ‘গেমঘরে’ নেওয়ার খবর তাঁরা পরিবারের সদস্যদের জানিয়েছিলেন। কিন্তু ওই দিনের পর থেকে আর কোনো খোঁজ নেই। তাঁদের ফোনেও পাওয়া যাচ্ছিল না। তাঁরাও কোনো যোগাযোগ করেননি। শুরু থেকে তাঁরা সবাই একসঙ্গেই ছিলেন।

আমরা ভেবেছি, অবৈধভাবে যাওয়ায় হয়তো যোগাযোগ করতে পারছে না। কিন্তু বৃহস্পতিবার রাতে লিবিয়া থেকে অচেনা এক বাংলাদেশি শ্রমিকের কল পেয়ে এবং ছোট ভাইয়ের পাসপোর্টের ছবি দেখে মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত হই।
মাহে আলম, আবদুল নবীর বড় ভাই

নিখোঁজ ব্যক্তিদের অভিভাবকেরা বলছেন, এক মাস ধরে আলম মিয়ার বাড়িতে গিয়ে সন্তানদের খোঁজখবর জানার চেষ্টা করেছেন তাঁরা। কিন্তু প্রতিবারই তাঁদের অপেক্ষা করতে বলা হয়েছে। আরও বলা হয়, অবৈধভাবে ইতালি যাওয়ায় হয়তো তাঁরা এখনই ফোন করতে পারছেন না, তবে সময় হলে তাঁরা নিজেরাই যোগাযোগ করবেন। কিন্তু এরই মধ্যে ভূমধ্যসাগর থেকে আবদুল নবীর লাশ উদ্ধারের খবরে তাঁদের নিশ্চিত ধারণা, আরও অনেকের সঙ্গে ইতালির উদ্দেশে রওনা হওয়ার পরই ভূমধ্যসাগরে ট্রলারডুবির ঘটনা ঘটে। কিন্তু এই খবর দালালের পক্ষ থেকে তাঁদের কোনো পরিবারকেই জানানো হয়নি। আবদুল নবীর লাশ উদ্ধারের ঘটনার পর থেকে দালালের সঙ্গেও যোগাযোগ করা যাচ্ছে না, তাঁদের পরিবারের সদস্যরাও কিছু বলছেন না।

আবদুল নবীর বড় ভাই মাহে আলম বলেন, এর আগেও একবার আলম দালালের মাধ্যমে ইতালি যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন নবী। সেবার তাঁরা লিবিয়া থেকে স্পিডবোটে ভূমধ্যসাগরে মাত্র ৮ থেকেক ১০ কিলোমিটার যাওয়ার পরই বোট ফেটে গিয়েছিল। পরে তাঁরা ভয়ে ফিরে আসেন। পরে দালালের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সালিস বৈঠকে বসে টাকা ও পাসপোর্ট ফেরত দিতে বলা হয়। কিন্তু আলম দালাল তা ফেরত না দিয়ে কম টাকায় আবার নিয়ে যাওয়ার লোভ দেখান। এরপরই চার মাস আগে আরও ১৩ জনের সঙ্গে আবার রওনা হন ছোট ভাই আবদুল নবী।

আরও পড়ুন

আবদুল নবীর সঙ্গে মাহে আলমের সর্বশেষ কথা হয়েছিল গত ২৩ মে। পরদিন ভোরে আরও অনেকের সঙ্গে ইতালির উদ্দেশে রওনা হওয়ার কথা জানিয়েছিলেন তিনি। এরপর আর যোগাযোগ হয়নি। মাহে আলম বলেন, ‘আমরা ভেবেছি, অবৈধভাবে যাওয়ায় হয়তো যোগাযোগ করতে পারছে না। কিন্তু বৃহস্পতিবার রাতে লিবিয়া থেকে অচেনা এক বাংলাদেশি শ্রমিকের কল পেয়ে এবং ছোট ভাইয়ের পাসপোর্টের ছবি দেখে মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত হই। দালাল আলম ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা ভূমধ্যসাগরে তাঁদের ট্রলারডুবির ঘটনা জানলেও আমাদের কিছু জানায়নি।’

আরও পড়ুন

লাশের ছবি দেখেছেন কি না, তা জানতে চাইলে মাহে আলম মিয়া বলেন, ‘আমাকে কল দেওয়া ওই ব্যক্তির কাছে ছোট ভাইয়ের লাশের ছবি দেখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তিনি ওই সময় বলেন, সাগর থেকে লাশ উদ্ধারের পর মর্গের ফ্রিজিং বক্সের ভেতরে তা তালাবদ্ধ করে পুলিশ চলে যাওয়ায় ছবি তুলে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবে এরপরই তিনি তাঁর পাসপোর্টের ছবি পাঠান।’

এ বিষয়ে নরসিংদীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) অনির্বাণ চৌধুরী বলেন, লিবিয়া থেকে অবৈধপথে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার জন্যই দালালের মাধ্যমে দেশ ছেড়েছিলেন এসব তরুণ-যুবক। এখন একজনের লাশ উদ্ধারের খবর শুনে নিখোঁজ ব্যক্তিদের নাম-পরিচয় সামনে আসছে। এটি খুবই দুঃখজনক। এ ঘটনায় নিহত ও নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে এখনো কোনো লিখিত অভিযোগ পাননি। লিখিত অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ বিষয়ে জেলা পুলিশের পক্ষ থেকেও খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। সবাই সচেতন না হলে দিনের পর দিন এভাবেই প্রাণের অপচয় হতে থাকবে বলে মন্তব্য করেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন