শিক্ষক–কর্মকর্তা নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ

পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ছবি : সংগৃহীত

পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (পবিপ্রবি) শিক্ষক-কর্মকর্তা নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা এই অনিয়মের অভিযোগ তোলার পর তদন্ত শুরু করেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) গঠিত কমিটি। নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগে আদালতে মামলাও করেছেন এক চাকরিপ্রত্যাশী।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও বিভিন্ন পদে চাকরিপ্রত্যাশীরা বলছেন, ইউজিসির অনুমোদন ছাড়া এবং নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লিখিত পদের চেয়ে বেশি জনবল নিয়োগ এখন রীতিতে পরিণত হয়েছে। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন পদে সাধারণ আবেদনকারীদের মৌখিক পরীক্ষায় ডাকাই হচ্ছে না। স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে সেসব পদে নিজেদের লোক নিয়োগ দিচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। অনিয়মের প্রতিবাদ জানালে কোনো কোনো নিয়োগ স্থগিত করা হলেও পরে সেই পদে অতিরিক্ত জনবল নিয়োগের ঘটনা ঘটেছে।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২২ সালের ১৬ নভেম্বর এবং এর আগের কয়েকটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে মোট ৩৯টি পদের বিপরীতে গত ২ ডিসেম্বর রিজেন্ট বোর্ডে ৫৮ জন শিক্ষক, কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০২২ সালের ১৭ অক্টোবরের বিজ্ঞপ্তিতে সেকশন অফিসার পদে তিনজনকে নিয়োগের কথা উল্লেখ ছিল। কিন্তু ২ ডিসেম্বর নিয়োগ পান ছয়জন। তাঁরা হলেন উপাচার্য অধ্যাপক স্বদেশ চন্দ্র সামন্তের ছেলে শাওন চন্দ্র সামন্ত, কর্মকর্তা সমিতির সভাপতি সাইদুর রহমানের ছোট ভাই মো. আরিফুর রহমান, সহকারী রেজিস্ট্রারের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা, বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসানের বড় ভাই মো. হাফিজুর রহমান, দুমকী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল কালামের ছেলে তানভীর হাসান ও জেলা যুবলীগের সম্পাদকের স্ত্রী তাকছিনা নাজনীন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০০৮ সালে ইউজিসির অনুমোদিত অর্গানোগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয়ে সেকশন অফিসারের পদ রয়েছে ৩০টি, কিন্তু এ পর্যন্ত  নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ৪৮ জনকে।

সেকশন অফিসার নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ চারজনের বিরুদ্ধে গত মঙ্গলবার পটুয়াখালীর সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে মামলা করেছেন ইসরাত জাহান নামের এক প্রার্থী। অন্য বিবাদীরা হলেন রেজিস্ট্রার সন্তোষ কুমার বসু, ট্রেজারার মোহাম্মদ আলী ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক কাজী শহীদুল্লাহ। বাদী অভিযোগ করেছেন, তিনি যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও নিয়োগ বাছাই বোর্ড কোনো পরীক্ষা না নিয়ে ছয়জনকে বিধিবহির্ভূতভাবে সেকশন অফিসার পদে নিয়োগ দেয়। নিয়োগ বোর্ড গঠনেও নিয়ম করা হয়েছে।
বাদীপক্ষের আইনজীবী হুমায়ূন কবির বলেন, আদালত মামলার পরবর্তী তারিখ ১০ মার্চ অভিযোগের জবাব দেওয়ার জন্য বিবাদীদের নোটিশ দিয়েছেন।

অভিযোগের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্বদেশ চন্দ্র সামন্ত প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা জ্ঞাতসারে কোনো অনিয়ম করিনি। আমরা চুরি করিনি, ঘুষ–বাণিজ্যও করিনি। শিক্ষক সমিতির অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ইউজিসি একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। তারাই অভিযোগের বিষয়গুলো তদন্ত করে দেখবে।’

ইউজিসিতে দেওয়া শিক্ষক সমিতির অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, ২০২২ সালের ২৬ মে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে প্রভাষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। সেখানে ইউজিসির অনুমোদন না নিয়েই পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি অ্যান্ড মার্কেটিং বিভাগে একজন প্রভাষক নিয়োগের কথা উল্লেখ করা হয়। সমালোচনার মুখে নিয়োগ কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। কিন্তু নতুন বিজ্ঞপ্তি না দিয়েই গত ২ ডিসেম্বর দুজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। তাঁদের একজন শেখ তানজিলা ইসলাম। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি কামরুজ্জামান সোহাগের স্ত্রী।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক জেহাদ পারভেজ বলেন, ‘নিয়োগগুলোর ক্ষেত্রে ইউজিসি থেকে লিখিত পরীক্ষা নেওয়ার একটি নির্দেশনা ছিল, রিজেন্ট বোর্ডে অনুমোদনও আছে, কিন্তু তা মানা হয়নি। আমরা এই ব্যত্যয়গুলো তুলে ধরেছি এবং শিক্ষক সমিতির সাধারণ সভায় সিদ্ধান্ত নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ দিয়েছি।’

২০২২ সালের ১১ অক্টোবর ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ ও অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড সিস্টেম ইনফরমেশন বিভাগ এবং ল অ্যান্ড ল্যান্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিভাগে তিনজন প্রভাষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। তবে মেধাতালিকায় থাকা প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের কেউ মৌখিক পরীক্ষার কার্ড না পেয়ে ক্ষুব্ধ হন। তাঁরা গত ১৯ নভেম্বর নিয়োগ কার্যক্রম স্থগিত করে বিধিমালা অনুযায়ী নিয়োগের দাবিতে রেজিস্ট্রার বরাবর স্মারকলিপি দেন। সেদিনই প্রভাষক পদে নিয়োগ স্থগিত করা হয়। এরপরও গত ২ ডিসেম্বর ল অ্যান্ড ল্যান্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিভাগে নিয়োগ দেওয়া হয় আমিনা সারওয়ার নামের একজনকে। তিনি ল্যান্ড রেকর্ড অ্যান্ড ট্রান্সফরমেশন বিভাগের চেয়ারম্যান সহকারী অধ্যাপক সাউদ বিন আলমের স্ত্রী।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার সন্তোষ কুমার বোস প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় এক হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন। বিভিন্ন সময়ে নিয়োগে কর্মরত কারও আত্মীয়স্বজন চাকরি পেয়ে থাকতে পারেন। তবে সবাই তাঁদের যোগ্যতা অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেকশন বোর্ডের সুপারিশে চাকরি পেয়েছেন।

নিয়োগপ্রক্রিয়ায় অনিয়মের অভিযোগ তুলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি গত বছরের ২৭ ডিসেম্বর মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা (মাউশি) বিভাগে লিখিত অভিযোগ করে। অভিযোগের তদন্ত করতে গত ১৪ জানুয়ারি মাউশি ইউজিসির চেয়ারম্যান বরাবর চিঠি পাঠায়। পরে ইউজিসির সচিব ফেরদৌস জামানকে আহ্বায়ক করে ২৮ জানুয়ারি তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এর এক মাস পর গতকাল বৃহস্পতিবার সরেজমিন তদন্ত শুরু করেছে এই কমিটি। কমিটির আহ্বায়ক ফেরদৌস জামান মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, তদন্তে এসে বেশির ভাগ কাগজপত্র পেয়েছেন। কিছু কাগজ আছে, পেতে সময় লাগবে। হয়তো আজ শুক্রবারই প্রশাসন দিয়ে দেবে। কিছু লোকের সাক্ষাৎকার নেওয়া হবে। এরপর তাঁরা প্রতিবেদন জমা দেবেন।