সীমান্তের ‘সীমানাহীন’ দুই গ্রামে ঈদ কাটে যেভাবে

কাঁটাতারের বেড়া নেই, কেবল পিলার দিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের দুটি গ্রামের সীমানা নির্ধারণ করা হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার তোলাছবি: প্রথম আলো

ইছামতী নদীর পাড়ে দুটি গ্রাম—বাংলাদেশের হাড়তদাহ আর ভারতের চক পানিতর। এই দুই গ্রামের সীমানা নির্ধারণের জন্য নেই কোনো কাঁটাতারের বেড়া; মাঝখান দিয়ে প্রবাহিত হয়নি কোনো নদী। প্রথম দেখায় বোঝার কোনো উপায় নেই বাংলাদেশ বা ভারতের সীমানা। কেবল পিলার দিয়ে এই দুই গ্রামের সীমানা নির্ধারণ করা হয়েছে।

সীমান্তের এই দুই গ্রামে ঈদের আমেজ কিছুটা আলাদা। ঈদের দিন দুই গ্রামের মানুষ একসঙ্গে নামাজ পড়েন। পরস্পরের বাড়িতে যান। তাঁরা নদীর ধার দিয়ে ঘুরে বেড়ান, ছবি তোলেন।

সাতক্ষীরা শহর থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে সদর উপজেলার হাড়তদাহ গ্রাম। পাশে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বসিরহাট মহকুমার চক পানিতর গ্রাম। এই দুই গ্রামের পাশ দিয়ে উত্তর-দক্ষিণে বয়ে গেছে ইছামতী নদী। সাতক্ষীরার কোথাও কোথাও ইছামতী নদী বাংলাদেশ ও ভারত বিভক্ত করলেও এখান থেকে উত্তর দিকে সম্পূর্ণ নদী ভারতের ভেতর দিয়ে বসিরহাট হয়ে উত্তর দিয়ে চলে গেছে। পাশে তারের কাঁটার বেড়া। এ দুই গ্রামের দক্ষিণে ইছামতীর নদীর মাঝবরাবর বাংলাদেশ ও ভারতের সীমানা।

এই দুই গ্রামের মানুষের ঈদ উদযাপন দেখতে আজ বৃহস্পতিবার সকালে সেখানে যান এ প্রতিবেদক। সকাল পৌনে ১০টার দিকে হাড়তদাহ গ্রামে পৌঁছানোর পর বর্ডার গার্ডবাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যরা সীমান্তের ওই এলাকায় যেতে আপত্তি জানান। পরে স্থানীয় এক সংবাদকর্মীর সহযোগিতায় সীমান্তের ১ নম্বর মেইন পিলার পর্যন্ত যাওয়ার অনুমতি পাওয়া যায়। সেখানে ছবি তুলতে পারলেও ভিডিও করতে নিষেধ করা হয়।

ইছামতী নদীর পাড়ে দুটি গ্রাম—বাংলাদেশের হাড়তদাহ ও ভারতের চক পানিতর
ছবি: সংগৃহীত

হাড়তদাহ গ্রামের কিছু তরুণের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা জানান, হাড়তদাহ গ্রামে ১৫টি পরিবার এবং সীমান্তের ওপারে চক পানিতরে ১৫টি পরিবারের বসবাস। সবাই ইসলামধর্মাবলম্বী। পেশায় তাঁরা কৃষক। এই দুই গ্রামের কোনো সীমানা নেই; শুধু পিলার দিয়ে চিহ্নিত করা আছে। জাকির হোসেন গাজী নামের একজন বাংলাদেশের বাসিন্দা। তাঁর রান্নাঘর রয়েছে ভারতের মধ্যে। আর বসতঘর বাংলাদেশের মধ্যে। আবার কালু সরদার ও রাজু সরদার নামের দুই ভাইয়ের বসতঘরের মাঝখান দিয়ে সীমানা চলে গেছে। একইভাবে রয়েছে বাংলাদেশ ও ভারতের অনেকের ঘরবাড়ি।

সীমান্তের এক নম্বর পিলার থেকে ১০০ গজ দূরে একটি দোকানে স্থানীয় তরুণ কামরুল ইসলামের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘আমাদের পূর্বপুরুষের বসবাস সীমান্তঘেঁষা ওই লাকায় (হাড়তদাহ)। তবে এখন আমি থাকি অন্য এলাকায়। আজ সকালে আমার দাদা, চাচাসহ দুই দেশের ৬০-৭০ জন একসঙ্গে ঈদের নামাজ পড়েছেন বাংলাদেশ অংশে অবস্থিত মসজিদ চত্বরে। দুই দেশের ৩০ পরিবারের মধ্যে যাতায়াত রয়েছে।

সীমান্তের হাড়তদাহ এলাকায় রয়েছে দুইটি দোকান। দুটি দোকানের মধ্যে একটির মালিক শরিফুল ইসলাম। ওই দোকানে বসে কথা হয় চক পানিতর গ্রামের বাসিন্দা দুই ছাত্রীর সঙ্গে। একজনের নাম মরিয়ম খাতুন; পানিতর উচ্চবিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী। অপরজন মারিয়া খাতুন; একই বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। তারা দোকানে কোমল পানীয় কিনতে এসেছে। তারা জানায়, এখানে দুই দেশের দুই গ্রামের মানুষ একত্রে ঈদের নামাজ পড়েন। এতে কোনো বাধা নেই। তবে বাইরে থেকে আত্মীয়স্বজন এলে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর (বিএসএফ) অনুমতি নিতে হয়। পরিচয়পত্র (আধার কার্ড) দেখিয়ে কোনো আত্মীয়ের বাড়িতে কয় দিন থাকবেন, তা আগে থেকে জানাতে হয়। তবে বাংলাদেশের পাশে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।

মরিয়ম ও মারিয়া আরও জানায়, সীমান্তের এই দুই গ্রামের বাসিন্দারা পরস্পরের আত্মীয়। ঈদ উপলক্ষে তাঁরা পরস্পরের বাড়িতে যান। আগে দূরদূরান্ত থেকে আত্মীয়স্বজন আসতেন। এখন কড়াকড়ির কারণে কেউ আসতে চান না।