বৈদ্যুতিক ফাঁদ উচ্ছেদের পর বাড়ছে হাতির সংখ্যা

বনের ভেতরে হাতির একটি পাল।কক্সবাজারের রামুর ভোমরিয়াঘোনা বনাঞ্চলে। সম্প্রতি তোলাপ্রথম আলো

কক্সবাজার শহর থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে ঈদগাঁও উপজেলার ভোমরিয়াঘোনা সংরক্ষিত বনাঞ্চল। শতবর্ষী গর্জন, বৈলাম, চাপালিশগাছে ভরপুর এই বনাঞ্চলের ভেতর দিয়ে পশ্চিম দিকে চলে গেছে হাতি চলাচলের একটি পথ বা করিডর।
গত মঙ্গলবার দুপুরে বনকর্মীদের সঙ্গে করিডরে গিয়ে হাতির দেখা পাওয়া গেল। বনকর্মীরা জানাল, হাতিটির বয়স ৪৫ বছর। হাতি চলাচলের ওই পথে নিয়মিতই যে হাতি চলাচল করে তার প্রমাণও পাওয়া গেল। সারা পথে পড়ে ছিল হাতির মল।
বনকর্মীরা জানালেন, বনে হাতির সংখ্যা বাড়ছে। বৈদ্যুতিক ফাঁদ উচ্ছেদ হওয়ায় হাতিরা এখন বনে নিরাপদ বোধ করছে। এ কারণে নিজেদের চলাচলের করিডরেও ফিরেছে হাতিরা।

ভোমরিয়াঘোনার পূর্ব দিকে ৩ কিলোমিটার গেলে ঈদগড়-বাইশারী বনাঞ্চল। সেখানেও ৬-৭টি হাতির বিচরণ দেখা গেল। এর মধ্যে একটি হাতির সঙ্গে শাবকও দেখা গেল। ঈদগড় বন রেঞ্জ কর্মকর্তা আবদুল জব্বার বলেন, এই বনাঞ্চলে গত তিন বছরে পাঁচটি হাতিশাবকের জন্ম হয়েছে। সর্বশেষ সাত মাস আগে একটি শাবক জন্ম নেয়। সব মিলিয়ে এই বনাঞ্চলে ২০-২৫টি হাতি আছে।

দেশের বৃহৎ হাতি প্রজনন এলাকা হচ্ছে ঈদগড়ের ‘ব্যাঙডেবা’ বনাঞ্চল। বড় গর্জন ও বৈলামগাছে ভরপুর ৫ হাজার ৫১৮ একরের এই বনাঞ্চলকে গত বছরের মার্চে ‘বন্য প্রাণী অভয়ারণ্য’ ঘোষণা করে সরকার। বেলা আড়াইটার দিকে ব্যাঙডেবা বনাঞ্চলে বিক্ষিপ্তভাবে সাত-আটটি হাতির বিচরণ চোখে পড়ে।

৩ বছরে ২৫ শাবকের জন্ম

প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা আইইউসিএন ও বন বিভাগের তথ্যমতে, গত ১৭ বছরে ৯০টি হাতি হত্যার শিকার হয়। যার মধ্যে ২০২০ সালে মারা হয় ১১টি হাতি। সব ঘটনাই চট্টগ্রাম-কক্সবাজার এলাকায়। এর মধ্যে সাতটি মারা হয়েছে বৈদ্যুতিক ফাঁদে। তবে বৈদ্যুতিক ফাঁদ উচ্ছেদ, বনায়ন ও সচেতনতা বাড়ার কারণে কক্সবাজারের বনে হাতির সংখ্যা বাড়ছে।

কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. আনোয়ার হোসেন সরকার প্রথম আলোকে বলেন, গত ৩ বছরে ব্যাঙডেবা, ঈদগড়, ভোমরিয়াঘোনা, ফাঁসিয়াখালী ও জোয়ারিয়ানালা বনাঞ্চলে ২৫টি হাতিশাবকের জন্ম হয়েছে। সব কটি সুস্থ আছে। মায়ের সঙ্গে হাতিশাবকগুলো বনাঞ্চলে নিরাপদে ঘুরেফিরে বড় হচ্ছে। আগে বৈদ্যুতিক ফাঁদ, কিংবা পাহাড়ের খাদ থেকে পড়ে হাতির মৃত্যু হতো, এখন তেমন আশঙ্কা নেই। বনকর্মী ও ভিলেজাররা হাতি ও শাবকগুলোকে সব সময় নজরদারিতে রাখেন।

সহকারী বন সংরক্ষক প্রান্তোষ চন্দ্র রায় বলেন, পাঁচ বছর আগেও কক্সবাজার ও বান্দরবানের বনাঞ্চলে হাতি ছিল ১৭৮টির মতো। ২৫ শাবকসহ এখন হাতির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২০৩টি। এর মধ্যে মা হাতি ২৩টি।

হাতির প্রজনন বৃদ্ধির কারণ জানতে চাইলে বন বিভাগের এই কর্মকর্তা বলেন, আগে বনাঞ্চলের গাছপালা উজাড় হওয়ায় হাতিরা খাদ্যসংকটে ভুগত। খাল-জলাশয়ের পানি শুকিয়ে যাওয়ায় বন্য হাতি পিপাসায় কাতর থাকত। খাদ্যের সন্ধানে লোকালয়ে নেমে পড়ত। তখন লোকজনের ঘরবাড়িতে হামলা করত। মানুষজন ফসল রক্ষার জন্য খেতের পাশে বৈদ্যুতিক সংযোগসংবলিত তার টেনে রাখত। রাতের বেলায় হাতির পাল ফসলের খেতে নামতে গিয়ে বৈদ্যুতিক তারে আটকা পড়ে মারা যেত। অনেক সময় গুলি করে হাতিকে হত্যা করা হতো। গত তিন বছরে অন্তত ৫২টি বৈদ্যুতিক ফাঁদ (তার) উচ্ছেদ করা হয়েছে। একটি ফাঁদে তার টানা থাকে ৫০০ গজ থেকে এক কিলোমিটার পর্যন্ত।

বনের ভেতরে হাতির একটি পাল।কক্সবাজারের রামুর ভোমরিয়াঘোনা বনাঞ্চলে। সম্প্রতি তোলা
প্রথম আলো

বেড়েছে সচেতনতা

হাতি হত্যা বিষয়ে মানুষ এখন অনেক সচেতন বলে জানালেন ডিএফও আনোয়ার হোসেন সরকার। তিনি বলেন, গত ৩ বছরে কক্সবাজার সদর, রামু, ঈদগাঁও, চকরিয়াসহ জেলার বিভিন্ন এলাকায় ৩২০টি সভা করে বনের ওপর নির্ভরশীল পাঁচ হাজারের বেশি মানুষকে বন্য প্রাণীর সুরক্ষা বিষয়ে সচেতন করা হয়েছে। হাতির আক্রমণে কেউ মারা গেলে ক্ষতিপূরণ হিসেবে তিন লাখ টাকা এবং ফসলের ক্ষতি করলে তার ন্যায্য ক্ষতিপূরণও দেওয়া হচ্ছে। যে কারণে গত দুই বছরে হাতি হত্যার ঘটনা ঘটেনি।

বনাঞ্চলে হাতির নিরাপদ আবাসস্থল ও প্রজননক্ষেত্র সৃজন, বনায়ন, হাতি চলাচলের করিডর সংস্কার, খাদ্যসংকটের অবসান ও বৈদ্যুতিক ফাঁদ উচ্ছেদ করায় হাতির সংখ্যা বাড়ছে বলে জানান বন কর্মকর্তারা। তাঁরা বলেন, হাতির প্রজননক্ষেত্র ও খাদ্যসংকট নিরসনে গত ৩ বছরে ১৪ হাজার ৮২০ একর ভূমিতে বনায়ন করা হয়েছে।

বন বিভাগের তথ্যমতে, দেশে হাতি চলাচলের করিডর আছে ১২টি। এর মধ্যে ৮টির অবস্থান কক্সবাজারে। এগুলো হচ্ছে উখিয়া-ঘুমধুম, তুলাবাগান-পানের ছড়া, রাজারকুল-নাইক্ষ্যংছড়ি, ভোমরিয়াঘোনা-রাজঘাট, তুলাতুলী-ঈদগড়, খুটাখালী-মেধাকচ্ছপিয়া, ফাঁসিয়াখালী-ছাইড়াখালী, ফাঁসিয়াখালী-মানিকপুর ইত্যাদি। চট্টগ্রামের চুনতি-সাতগর বনাঞ্চলেও হাতি চলাচলের আরেকটি করিডর আছে।