রমেশ সেনকে পরীক্ষায় ফেলেছেন অরুণাংশু

  • এই নির্বাচন ঘিরে আওয়ামী লীগের বিভক্তি দীর্ঘ করতে পারে।

  • নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করেও দূর থেকে সুবিধা পেতে পারে বিএনপি।

ঠাকুরগাঁও জেলার মানচিত্র

বিএনপিবিহীন ঠাকুরগাঁও সদরের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনটি কার্যত কয়েকটি ভাগে বিভক্ত স্থানীয় আওয়ামী লীগকে পরীক্ষায় ফেলেছে। পরীক্ষাটি মূলত স্থানীয় সংসদ সদস্য (ঠাকুরগাঁও ১) রমেশ চন্দ্র সেনের। কারণ, তারই দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত সহযোগী অরুণাংশু দত্ত (টিটো) এবার তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে প্রার্থী হয়েছেন।

ঠাকুরগাঁওয়ের আওয়ামী লীগের কর্মীরা বলছেন, সদর উপজেলা নির্বাচনের মাধ্যেম কার্যত আগামী দিনে স্থানীয় আওয়ামী লীগে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা, সেই সঙ্গে জাতীয় নির্বাচনের ভিত্তি রচনারই কাজ চলছে। এই নির্বাচন ঘিরে আওয়ামী লীগের বিভক্তি দীর্ঘ করতে পারে। নির্বাচনের ফলাফল ঠাকুরগাঁওয়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতির বর্তমান দৃশ্যপট পাল্টে দিতে পারে।

মাঠের যে পরিস্থিতি, তাতে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের চারজন নেতার মধ্যে অরুণাংশু দত্ত (আনারস) শক্ত অবস্থানে আছেন।

অন্যদিকে সুষ্ঠু নির্বাচনের আশ্বাসে বিএনপি কখনো নির্বাচনে অংশ নিলে, সে নির্বাচনেও এর প্রভাব ফেলতে পারে। বিএনপি এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করেও দূর থেকে সুবিধা পেতে পারে।

জেলা বিএনপির সহসভাপতি ওবায়দুল্লাহ মাসুদ প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপি নির্বাচনে না থাকায় আওয়ামী লীগের কোন্দল বেড়েছে, এটা বিএনপির বড় প্রাপ্তি। এ ছাড়া ভোটারবিহীন নির্বাচন নিয়ে ষে কথাগুলো বিএনপি বলত, সেগুলো এখন আওয়ামী লীগের নেতাদের মুখ থেকেই বের হচ্ছে।

একাধিক রাজনৈতিক কর্মী ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বললে তাঁরা জানান, ভোটের আগের দিন গতকাল সোমবার পর্যন্ত মাঠের যে পরিস্থিতি, তাতে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের চারজন নেতার মধ্যে অরুণাংশু দত্ত (আনারস) শক্ত অবস্থানে আছেন। সাংগঠনিক শক্তি-সামর্থে৵ প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আছেন মোশারুল ইসলাম সরকার (মোটরসাইকেল)। প্রার্থী অন্য তিন নেতা হলেন, উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি রওশনুল হক (ঘোড়া) ও আওয়ামী লীগের নেতা কামরুল হাসান (কাপ পিরিচ)।

অরুণাংশু দত্ত ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান। মোশারুল ইসলাম সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। মোশারুলের প্রতি রমেশ চন্দ্র সেনের সক্রিয় সমর্থন রয়েছে বলে এলাকায় ব্যাপক প্রচার আছে। অরুণাংশু দত্ত নিজেও প্রথম আলোকে বলেছেন, তাকে হারাতে শীর্ষ পর্যায় থেকে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। নেতা-কর্মীরা অভিযোগ করেছেন, কাকা (রমেশ চন্দ্র সেন) তাঁদের মোটরসাইকেলের ভোট করতে চাপ দিচ্ছেন।

সংসদ সদস্য রমেশ চন্দ্র সেন কেন অরুণাংশু দত্তকে সমর্থন করছেন না, তা নিয়ে আওয়ামী লীগের ভেতরে–বাইরের রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে নানা রকম ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ চলছে। একাধিক নেতার মূল্যায়ন হচ্ছে, রমেশ চন্দ্র সেনের উত্থানের পেছনে বড় ভূমিকা রাখেন অরুণাংশু দত্ত। কার্যত রমেশ চন্দ্র সেনের অবর্তমানে অরুণাংশু দত্তের দৃষ্টি সংসদের দিকে। বিরোধটা এখানেই। নিঃসন্তান রমেশ চন্দ্র সেন তাঁর জায়গায় ভাতিজা রুহিয়া থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি পার্থ সারথি সেনকে প্রতিষ্ঠা করতে চান। সে জন্যই তিনি অরুনাংশু দত্তকে এড়িয়ে চলছেন। অনেকটা প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে সমর্থন দিয়েছেন মোশারুল ইসলামকে।

অবশ্য রমেশ চন্দ্র সেন প্রথম আলোকে বলেন, সবাই আওয়ামী লীগের প্রার্থী। এখানে কারও পক্ষ নেওয়ার সুযোগ নেই। নিজের উত্তরসূরির বিষয়ে সংসদ সদস্য বলেন, যোগ্যতা থাকলে নেতৃত্ব এমনিতেই ধরা দেবে। এসব বলে শৃঙ্খলা নষ্ট করার সুযোগ নেই।

স্থানীয় রাজনৈতিক কর্মীরা বলছেন, নির্বাচনে প্রায় সোয়া লাখ সংখ্যালঘু ভোটারই জয়–পরাজয়ে মুখ্য ভূমিকা রাখবেন। সংখ্যালঘু ভোটারদের ওপর রমেশ চন্দ্র সেনের বিপুল প্রভাব রয়েছে। এখন অরুণাংশু দত্ত এই বাধা ডিঙিয়ে স্বগোত্রীয় মানুষদের কতটা পক্ষে টানতে পারবেন, অন্যদিকে অরুণাংশ দত্তকে পাশ কাটিয়ে সংখ্যালঘু ভোটারদের মোশারুলের পক্ষে আনা যাবে, সেটাই লক্ষণীয় বিষয়।

নির্বাচন–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিএনপি নির্বাচনে না থাকায় কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি কম হতে পারে। ভোটের হার কম হলে অরুণাংশু দত্তের জয়ের সম্ভাবনা থাকবে। সে জন্য বিএনপির ভোটারদের দিকে কোনো কোনো প্রার্থীর বিশেষ নজর রয়েছে। এ ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে নানা কারণে রমেশ চন্দ্র সেনের ওপর বিএনপির নেতা–কর্মী, এমনকি সাধারণ সমর্থকেরাও বিরক্ত। ফলে তাঁর সমর্থিত প্রার্থীর বিপক্ষে যেতে পারে বিএনপির সাধারণ সমর্থকদের ভোট।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঠাকুরগাঁও জেলার সন্তান। শহরেই তাঁর পৈতৃক বাড়ি। উপজেলা নির্বাচনে বিএনপির কোনো প্রার্থী নেই। তাই নির্বাচনী মাঠে বিএনপির কোনো সমালোচনা নেই। বরং বর্তমান ভোটারবিহীন নির্বাচনের ওপর জনগণের যে আস্থা নেই, সে কথাগুলোই নির্বাচনী সভায় আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থীদের কেউ কেউ বলছেন। ফলে নির্বাচন বর্জন করে বিএনপির নেতা–কর্মীরা অনেকটা ফুরফুরে মেজাজে আছেন।

দলীয় কার্যালয়েই গতকাল সকালে কথা হয় জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আনসারুল হকের সঙ্গে। এই নির্বাচনের সঙ্গে বিএনপির কোনো সংশ্লেষ নেই বলে জানান তিনি। তবে বিএনপির এই নেতা স্থানীয় সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক পরিবেশ নষ্ট করার অভিযোগ করেন। এই নির্বাচনে তাঁর চাওয়ার বিরুদ্ধে তাঁদের নৈতিক অবস্থান থাকবে বলে জানান আনসারুল।

ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার ভোটার সংখ্যা ৪ লাখ ৮৭ হাজার। নির্বাচনী এলাকার আয়তন এবং ভোটার সংখ্যা বিবেচনায় ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা নির্বাচন যেন জাতীয় সংসদ (ঠাকুরগাঁও-১) নির্বাচনেরই প্রতিচ্ছবি। কারণ, সদর উপজেলার ২০টি ইউনিয়ন এবং একটি পৌরসভা মিলে ঠাকুরগাঁও সদর আসন। আজ ২২টি ইউনিয়ন এবং একটি পৌরসভা হচ্ছে। বাস্তবে একই আয়তনে, একই সংখ্যক ভোটারের নির্বাচন হচ্ছে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচনে। অন্যদিকে নেপথ্যেও আগামী সংসদ নির্বাচনের ভিত্তি রচনার কাজ চলছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।