ট্রলারে চেপে যেতে চেয়েছিলেন মালয়েশিয়া, ঠাঁই হলো মিয়ানমারের কারাগারে

মিয়ানমারের কারাগারে আড়াই বছর ধরে কারা ভোগ করে দেশে ফেরেন লবণ চাষি মোস্তাক আহমদ(ডানে)। গতকাল বিকালে কক্সবাজার শহরের বিআইডব্লিউটিএ-জেটি ঘাটেছবি-প্রথম আলো

টেকনাফ সমুদ্র উপকূল দিয়ে ট্রলারে চেপে ভালো চাকরির আশায় মালয়েশিয়ায় যেতে চেয়েছিলেন কক্সবাজারের মহেশখালীর কুতুবজোম এলাকার লবণচাষি মোস্তাক আহমদ। কিন্তু সাগরের মাঝপথে ট্রলারটির ইঞ্জিন বিকল হওয়ায় তিনিসহ ট্রলারের ৫০ জন যাত্রী সাগরে ভাসছিলেন। পাঁচ দিন পর ট্রলারটি মিয়ানমার নৌবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। এরপর কপালে জোটে কারাভোগ। দীর্ঘ আড়াই বছর কারাভোগের পর গতকাল বুধবার বিকেলে মিয়ানমার নৌবাহিনীর একটি জাহাজে কক্সবাজার ফিরে আসেন মোস্তাক। তাঁর সঙ্গে ফিরেছেন সাজার মেয়াদ শেষ হওয়া আরও ১৭২ জন বাংলাদেশি।

গতকাল বুধবার বিকেলে শহরের বাঁকখালী নদীর নুনিয়াছটার বিআইডব্লিউটির জেটিঘাটে মোস্তাক আহমদ (৪২) প্রথম আলোকে বলেন, দালালের খপ্পরে পড়ে তিনিসহ টেকনাফ, রামু ও মহেশখালীর ৫০ জন সমুদ্রপথে মালয়েশিয়াতে রওনা দেন। দালালেরা মাথাপিছু ৫০-৮০ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়ে ভালো চাকরির আশ্বাস দিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁদের মালয়েশিয়া যাওয়া হয়নি। উল্টো আড়াই বছর মিয়ানমারের সিথুয়ে কারাগারে বন্দী জীবন কাটাতে হলো।

মিয়ানমারের কারাগারে দেড় বছর কারাভোগের পর কক্সবাজারে ফিরে আসেন টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ জালিয়াপাড়ার দুই ভাই সাইফুল ও ইসহাক। গতকাল বিকালে কক্সবাজার শহরের বিআইডব্লিউটিএ-জেটি ঘাটে
ছবি-প্রথম আলো

সিথুয়ের কারাগারে প্রতিদিন তাঁদের দুপুরে এক বেলা করে খাবার দেওয়া হতো জানিয়ে মোস্তাক বলেন, ভাতের সঙ্গে দেওয়া হতো সবজি। মাছ-মাংস মাসে একবারেই খাওয়া হতো না। সকাল ও রাতে দেওয়া হতো গুড়-রুটি-সবজি। সারা দিন কারাগারের ভারী কাজে ব্যস্ত রাখা হতো। কাজ না করলে বর্বর নিযাতন চালানো হতো। অসুস্থ হয়ে পড়লে ওষুধও দেওয়া হতো না। আড়াই বছর পর বাবা-মায়ের কাছে ফিরতে পেরে আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্টি জ্ঞাপন করে মোস্তাক বলেন, মিয়ানমারের কারাগার থেকে দেশে ফিরতে পারব, এই আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টায় ফিরেছি। মনে হচ্ছে নতুন জীবন পেয়েছি।

মিয়ানমারের কারাগারে সাজার মেয়াদ শেষ হওয়া ১৭৩ জন বাংলাদেশিকে গতকাল দুপুরে দেশটির নৌবাহিনীর একটি জাহাজে করে কক্সবাজার আনা হয়। তাঁদের প্রথমে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ–বিজিবির কাছে হস্তান্তর করা হয়। এরপর পুলিশ ইমিগ্রেশনসহ আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে যাঁদের বিরুদ্ধে থানায় মামলা নেই, তাঁদের আত্মীয়স্বজনের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

পুলিশের দেওয়া তথ্যমতে, ১৭৩ জনের মধ্যে কক্সবাজার জেলার ১২৯ জন, বান্দরবানের ৩০ জন, রাঙামাটির ৭ জন, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, রাজবাড়ী, নরসিংদী ও নীলফামারী জেলার একজন করে আরও ৭ জন রয়েছেন।

বিআইডব্লিউটিএ জেটিঘাট থেকে বেলা আড়াইটার দিকে ছাড়া পান মহেশখালীর কুতুবজোনের গোলাম সুলতানের ছেলে মোস্তাক আহমদ। তাঁর পরনে ছিল লাল গেঞ্জি, মুখে দাঁড়ি। পরিবারের সদস্যদের জাপটে ধরে মোস্তাক শুরু করেন কান্নাকাটি। এরপর মিয়ানমার কারাগারে থাকাকালীন অত্যাচার–নিযাতনের বর্ণনা তুলে ধরেন।

মোস্তাকের পর ছাড়া পান মহেশখালীর কালারমারছড়ার সিরাজুল ইসলাম। তিনি একই ট্রলারে মালয়েশিয়ার যাত্রী ছিলেন। তিনি বলেন, দালাল চক্রের খপ্পরে পড়ে তাঁকে আড়াই বছর কারাভোগ করতে হয়েছে। বাড়িতে পৌঁছে দালালদের বিরুদ্ধে লড়বেন তিনি। যেন অন্য কেউ দালালের খপ্পরে না পড়েন। জেটিঘাটে কথা হয় কারাভোগ শেষে বাড়ি ফেরা আরও ১০-১২ জনের সঙ্গে।

১৪ মাস আগে দালালের খপ্পরে পড়ে মালয়েশিয়া রওনা দেন উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের ফারিরবিল গ্রামের আরাফাত হোসেন (২০)। গতকাল বিকেলে বিআইডব্লিউটিএ জেটিঘাটে তাঁকে গ্রহণ করেন মা ফরিদা খাতুন। ছেলেকে বুকে জড়িয়ে কান্নাকাটি করেন মা। তারপর বলেন, আরাফাত এলাকায় অটোরিকশা চালাতেন। ১৪ মাস আগে মালয়েশিয়া যাওয়ার কথা বলে ঘর থেকে বের হয়ে যায়, আর কোনো খোঁজ ছিল না। ৯ মাস পর ছেলের চিঠি পান তিনি। তাতে বলা হয়, আরাফাত মিয়ানমারের কারাগারে বন্দী। ছেলেকে ফিরে পাওয়ায় তিনি সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।

কক্সবাজার পুলিশ সুপার মো. মাহাফুজুল ইসলাম বলেন, ফেরত আসা ১৭৩ বাংলাদেশিকে প্রথমে বিজিবি গ্রহণ করে পুলিশকে হস্তান্তর করে। যাচাই-বাছাই শেষে ১৭৩ জনের মধ্যে যাঁদের বিরুদ্ধে মামলা নেই, তাঁদের জেটিঘাটে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। অবশিষ্টদের নিজ নিজ থানায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।