পুলিশ পরিচয়ে ‘নিখোঁজ’ দুজনকে ‘উদ্ধার করে’ চাঁদা দাবি, পিটিয়ে ছাত্রদল নেতাকে পুলিশে সোপর্দ

ছাত্রদল নেতা আব্দুর রাজ্জাকছবি: সংগৃহীত

দিনাজপুরে নিখোঁজের জিডির (সাধারণ ডায়েরি) সূত্র ধরে এক তরুণ ও তরুণীকে ‘উদ্ধার করে’ দিয়ে পুলিশ পরিচয়ে চাঁদা দাবির অভিযোগ উঠেছে এক ছাত্রদল নেতার বিরুদ্ধে। ভুয়া পুলিশের পরিচয় জানাজানি হওয়ার পর ওই ছাত্রদল নেতাসহ দুজনকে পিটিয়ে পুলিশে সোপর্দ করেছেন এলাকার লোকজন। গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে সদর উপজেলার শেখপুরা ইউনিয়নের ভাটিনা ঠাকুরবাড়ি চাকলাপাড়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।

ছাত্রদলের ওই নেতার নাম আব্দুর রাজ্জাক (৩৫)। তিনি সদর উপজেলার নহনা গ্রামের বাসিন্দা এবং সদর উপজেলা ছাত্রদলের আহ্বায়ক। আটক অপরজন হলেন ছাত্রদলের কর্মী একই এলাকার শাহাদত হোসেনের ছেলে মো. আপেল (২২)। এ ঘটনায় ইমন চন্দ্র বর্মন (২২) নামের ওই তরুণের বাবা বাদী হয়ে কোতোয়ালি থানায় মামলা করেছেন। মামলায় ওই দুজনসহ ছয়জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা দুই থেকে তিনজনকে আসামি করা হয়েছে।

এ ঘটনার পর আব্দুর রাজ্জাককে বহিষ্কার করার কথা জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ছাত্রদল। আজ শুক্রবার ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে দিনাজপুর সদর উপজেলা ছাত্রদলের আহ্বায়ক আব্দুর রাজ্জাককে সাংগঠনিক পদ থেকে বহিষ্কার করা হলো। একই সঙ্গে ছাত্রদলের সব পর্যায়ের নেতা–কর্মীদের তাঁর সঙ্গে কোনো সাংগঠনিক সম্পর্ক না রাখার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ছাত্রদল সভাপতি রাকিবুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক নাছিরউদ্দিন এই সিদ্ধান্তের অনুমোদন দিয়েছেন।

পুলিশ, এলাকাবাসী ও পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, এক মাস আগে ভালোবেসে বাড়ি ছেড়েছিলেন ইমন চন্দ্র বর্মন (২২) ও ওই তরুণী। নিখোঁজের চার দিন পরে থানায় অভিযোগ করেছিলেন ওই তরুণীর বাবা। তদন্তে অগ্রগতি না দেখে ৭ জানুয়ারি পুনরায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। জিডিতে তার বয়স ১৬ বছর উল্লেখ করা হলেও পুলিশ বলছে, জন্মনিবন্ধন সনদ অনুযায়ী তাঁর বয়স ১৮ বছর। সেই জিডির অনুলিপি নিয়ে নিজেকে পুলিশ পরিচয় দিয়ে ‘উদ্ধার অভিযানে’ নামেন ছাত্রদল নেতা আব্দুর রাজ্জাক। একপর্যায়ে টাঙ্গাইল থেকে দুজনকে উদ্ধারও করেন। তবে উদ্ধারের পর থানায় না নিয়ে নিজের জিম্মায় রেখে ইমনের বাবার কাছে মামলার ভয় দেখিয়ে এক লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন। পরে ভুয়া পুলিশ পরিচয়ে চাঁদা দাবির অভিযোগে স্থানীয় লোকজনের মারধরের শিকার হয়ে পুলিশের হাতে আটক হন ওই ছাত্রদল নেতা ও তাঁর এক সহযোগী।

মামলার এজাহারে বাদী চৈতু বর্মন উল্লেখ করেছেন, তাঁর ছেলে ইমন চন্দ্র বর্মন টাঙ্গাইলে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। ৭ জানুয়ারি রাতে ছাত্রদল নেতা আব্দুর রাজ্জাক ও তাঁর কয়েকজন সহযোগী পুলিশ পরিচয়ে চৈতু বর্মনের বাড়িতে যান। থানায় তাঁর নামে অভিযোগ আছে দাবি করে একটি সাদা মাইক্রোবাসে তাঁকে তুলে নিয়ে টাঙ্গাইলে ছেলে ইমন চন্দ্রের ভাড়া বাসায় যায়। গত বুধবার সন্ধ্যায় চৈতু বর্মন ও ছেলে ইমন চন্দ্রকে সেই মাইক্রোবাসে দিনাজপুরের মাধবপুর এলাকায় ওই মেয়ের বাড়িতে নিয়ে আসে। সেখানে বাবা-ছেলেকে মারধর করে এক লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন ছাত্রদল নেতা আব্দুর রাজ্জাক। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পরে স্থানীয় লোকজন আব্দুর রাজ্জাকের আসল পরিচয় জানতে পেরে তাঁকে মারধর করেন এবং জরুরি সেবা ৯৯৯–এ ফোন করেন। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে আব্দুর রাজ্জাক ও তাঁর সহযোগী আপেলকে আটক করে থানা হেফাজতে নিয়ে আসে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মুঠোফোনে ওই তরুণীর বাবা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর মেয়ে এবার মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। মাসখানেক হয় মেয়ের খোঁজ পান না। পুলিশের কাছেও সঠিক কোনো তথ্য পাচ্ছিলেন না। পরে পুলিশ ও রাজ্জাকের মাধ্যমে মেয়ের খোঁজ পান। ছেলের বাবার সঙ্গে পরামর্শ করে বিয়ের বিষয়টি দুই পরিবার মেনে নিয়েছে। দুই অভিভাবক মিলে রাজ্জাককে সঙ্গে নিয়ে টাঙ্গাইল থেকে তাদের নিয়ে আসেন। বৃহস্পতিবার বিকেলে মেয়েকে বাড়িতে নিয়ে যান। ছেলের বাবা ছেলেকে বাড়িতে নিয়ে যান। এরপর কী ঘটেছে, তিনি কিছুই বলতে পারেন না। রাতে রাজ্জাককে আটক এবং মামলার বিষয়ে জানতে পারেন।

ওই তরুণী নিখোঁজের বিষয়ে কোতোয়ালি থানায় করা জিডির তদন্তের দায়িত্বে ছিলেন উপপরিদর্শক (এসআই) আহনাফ তাহমিদ। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘জন্মনিবন্ধনের প্রমাণপত্রে দেখতে পাই, ছেলেমেয়ে প্রাপ্তবয়স্ক। তাদের বিয়ে হয়েছে। তারপরও আমরা পুলিশের পক্ষ থেকে ম্যানুয়ালি খোঁজখবর করার চেষ্টা করেছি। তাদের খোঁজ পাওয়া যায়নি।’

এ বিষয়ে দিনাজপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম) আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘জরুরি সেবায় ফোন পেয়ে কোতোয়ালি থানার একটি টহল দল ঘটনাস্থলে যায়। সেখান থেকে দুজনকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসে। পরে ছেলের বাবা বাদী হয়ে বৃহস্পতিবার রাতে থানায় একটি মামলা করেছেন। সেই মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আটককৃতদের জেলহাজতে নেওয়ার প্রক্রিয়া চলমান।’