বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে পানি সরবরাহ: ২২ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পে শুরুতেই ধীরগতি
সঞ্চালন লাইন হবে প্রায় ১৫২ কিলোমিটার দীর্ঘ।
সম্ভাব্যতা যাচাই শুরু হয় ২০২৩ সালের আগস্টে।
এক হাজার লিটার পানির দাম পড়বে ৯১ দশমিক ৩০ টাকা।
মেঘনা নদী থেকে পানি নিয়ে চট্টগ্রামের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে সরবরাহের জন্য সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বে একটি প্রকল্প নিয়েছিল সরকার। ২০২২ সালের ৩১ আগস্ট অর্থনীতি বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির (সিসিইএ) সভায় প্রকল্পটি নীতিগত অনুমোদন পায়। এরপর ২০২৩ সালের আগস্টে শুরু হয় সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ। চার মাসের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু সাত মাস পার হলেও এখনো সম্ভাব্যতা যাচাই শেষ হয়নি।
প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব পেয়েছে চট্টগ্রাম ওয়াসা। সংস্থাটির দেওয়া প্রকল্পের সারসংক্ষেপে উল্লেখ করা হয়েছে, এটি বাস্তবায়নে মোট খরচ হবে ২২ হাজার ৬৯ কোটি টাকা। এতে ৫০ কোটি লিটার পরিশোধনক্ষমতার পানি শোধনাগার নির্মাণ করা হবে। প্রায় ১৫২ কিলোমিটার দীর্ঘ সঞ্চালন লাইনের মাধ্যমে মেঘনা নদী থেকে পানি পৌঁছাবে শিল্পনগরে।
সম্ভাব্যতা যাচাই শেষে কাজ শুরু হওয়ার সময় ধরা হয়েছিল চলতি বছরের জানুয়ারিতে। কিন্তু সম্ভাব্যতা যাচাই এখনো শেষ হয়নি।
এই প্রকল্পে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে রয়েছে কোরিয়া ওভারসিজ ইনফ্রাস্ট্রাকচার অ্যান্ড আরবান ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন। ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান হলো এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যাংক অব কোরিয়া এবং যুক্ত রয়েছে কোরীয় প্রতিষ্ঠান তায়ং ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড। প্রকল্পে সরকারি ব্যয় ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৮৯৬ কোটি টাকা ও বেসরকারি ব্যয় ১৩ হাজার ২০০ কোটি টাকা। সরকারি ব্যয়ের মধ্যে জমি অধিগ্রহণ, ক্ষতিপূরণ, নদী শাসনসহ বিভিন্ন খাত রয়েছে। অন্যদিকে বেসরকারি খাত থেকে নির্মাণ ব্যয় মেটানো হবে।
প্রকল্পের নথি অনুযায়ী, কাজ শুরু হওয়ার সম্ভাব্য সময় ধরা হয়েছিল চলতি বছরের জানুয়ারিতে। প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হওয়ার কথা ২০২৭ সালের ডিসেম্বরে। এ ছাড়া দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ শুরু হওয়ার কথা রয়েছে ২০২৮ সালের জানুয়ারিতে, শেষ হওয়ার কথা ২০৩১ সালের ডিসেম্বরে। কিন্তু সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শেষ না হওয়ায় নির্ধারিত সময়ে নির্মাণকাজ শেষ হওয়া নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে।
প্রকল্প-সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০২২ সালের ২৪ জুলাই শিল্পনগর এলাকাকে চট্টগ্রাম ওয়াসার কাজের অধিক্ষেত্র ভুক্ত এলাকা হিসেবে অনুমোদন দেওয়া হয়। পরে ২০২৩ সালের ৪ জুলাই সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি সই হয়।
জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক ও ওয়াসার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. নুরুল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, চার মাসের মধ্যে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। এরপর সময় এক দফা বাড়ানো হয়। চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত সময় রয়েছে। ইতিমধ্যে ৭৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।
বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় এলাকা সন্দ্বীপ চ্যানেলের পাশে ১৩৭ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে গড়ে তোলা হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড ও মিরসরাই এবং ফেনীর সোনাগাজী উপজেলা ঘিরে এই শিল্পনগরের আয়তন ৩৩ হাজার ৮০৫ একর। এর ৪১ শতাংশ বা ১৪ হাজার একরে থাকবে শুধু শিল্পকারখানা। ইতিমধ্যে পাঁচটি কারখানা উৎপাদন কার্যক্রম শুরু করেছে। আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান উৎপাদনে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় এসব প্রতিষ্ঠান পানি ব্যবহার করছে।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে এম ফজলুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্প শুরুর বিষয়টি নির্ভর করছে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব কর্তৃপক্ষের (পিপিপিএ) ওপর।
পিপিপিএর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মোস্তাফিজুর রহমানের কাছে মুঠোফোনে জানতে চাইলে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজের বিষয়ে তিনি বিস্তারিত জানাতে পারেননি। সম্প্রতি যোগদান করায় তিনি বেশি কিছু জানেন না বলে মন্তব্য করেন।
পানির চাহিদা বাড়ছে
বেজার মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী, বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে পানির চাহিদা ২০৪০ সালে পৌঁছাবে দৈনিক ৯৮ কোটি লিটার। তবে মেঘনা নদী থেকে পানি সরবরাহ প্রকল্পের একটি নথিতে বলা হয়, ২০৪০ সালে পানির চাহিদা হবে ৭০ কোটি লিটার, ২০৩৫ সালে ৬৫ কোটি লিটার, ২০৩০ সালে ৫৯ কোটি লিটার, ২০২৫ সালে ৪৬ কোটি লিটার।
প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রকল্পের সুবিধা পেতে পাঁচ থেকে ছয় বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এর মধ্যে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন কার্যক্রম শুরু করার কথা রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের পানির চাহিদা কীভাবে মেটানো যাবে, তা নিয়ে এখনই ভাবতে হবে।
শিল্পনগরে ২০ একর জায়গার ওপর শিল্পকারখানা গড়ে তুলেছে মডার্ন সিনটেক্স লিমিটেড। গত ২৯ জুন থেকে শুরু হয়েছে উৎপাদন কার্যক্রম। দৈনিক ৪৬০ টন উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে। বর্তমানে লক্ষ্যমাত্রার ৭০ শতাংশ পর্যন্ত উৎপাদন হচ্ছে।
প্রতিষ্ঠানটির নথিপত্র অনুযায়ী, তিন ধরনের পণ্য তৈরি হচ্ছে কারখানায়। এগুলো হলো সুতা, তুলা ও দানা। তৈরি পোশাক, হোম টেক্সটাইল, টেকনিক্যাল টেক্সটাইল, নেট, জুতা ও অটো মোটিভের কাঁচামাল হিসেবে পণ্যগুলো ব্যবহার করা হয়।
প্রতিষ্ঠানটির মহাব্যবস্থাপক সফল বড়ুয়া প্রথম আলোকে বলেন, উৎপাদন চালাতে প্রতি ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৫৫ হাজার লিটার পানি দরকার হচ্ছে। উৎপাদন পুরোদমে শুরু হলে প্রতি ঘণ্টায় ১ লাখ থেকে ১ লাখ ২০ হাজার লিটার পানির প্রয়োজন হবে। বর্তমানে নিজস্ব ব্যবস্থাপনা ও বেজার দেওয়া গভীর নলকূপ থেকে পানি নেওয়া হচ্ছে। এক হাজার লিটার পানির দাম পড়ছে ৩২ টাকা।
ওয়াসা সূত্র জানায়, মেঘনা নদী থেকে পানি শিল্পনগর পর্যন্ত আনতে নির্মাণ করতে হবে ১৫২ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন। ওয়াসা বলছে, মোট ব্যয়ের ৭০ শতাংশই যাবে পাইপলাইন নির্মাণ করতে। এত দূরে পানি টেনে আনতে গিয়ে দাম কত পড়বে, তা নিয়ে কাজ করেছে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। হিসাব অনুযায়ী, ১ হাজার লিটার পানির দাম পড়বে ৯১ দশমিক ৩০ টাকা। এর সঙ্গে সার্ভিস চার্জ যোগ হওয়ার কথা রয়েছে।