আগুনে পুড়ল সুমির স্বপ্ন, পরিবার হারাল মাথা গোঁজার ঠাঁই
সামনে উচ্চমাধ্যমিক (এইচএসসি) পরীক্ষা। ঝালকাঠির আমুয়া শহীদ রাজা ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থী সুমি আক্তার তাই রাত জেগে পড়াশোনা শেষে ক্লান্ত শরীরে ঘুমিয়ে পড়ে। তার স্বপ্ন ছিল পড়াশোনা শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর। বাবার মৃত্যুর পর ভাইয়ের কাঁধে সংসারের দায়িত্ব, আর সেই বোঝা কিছুটা ভাগ করে নিতে চেয়েছিল সুমি। কিন্তু ভয়াবহ এক অগ্নিকাণ্ডে নিমিষেই সুমির সেই স্বপ্ন পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে।
বরগুনার বামনা উপজেলার চালিতাবুনিয়া গ্রামে গত মঙ্গলবার ভোরে আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে সুমিদের একমাত্র সম্বল বসতঘর। বাড়ির মালপত্র সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত ঘটে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কাঠ-টিনের জরাজীর্ণ ঘরটিতে আগুন ছড়িয়ে পড়ে মুহূর্তেই। সেদিন সুমির ঘুম ভাঙে মায়ের চিৎকারে। আগুনঘেরা ঘর থেকে মা পারুল বেগম সুমিকে নিয়ে বের হতে পারলেও ঘরের ভেতর রয়ে যায় তাঁদের সব সহায়-সম্পদ, বইপত্র, পোশাক, প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র।
সুমির বাবা শামসুল হক ছিলেন দিনমজুর। করোনাকালে শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তিনি। জমিজমা বলতে এই বসতভিটাটুকুই আছে তাদের একমাত্র সম্বল। সুমির বড় ভাই সাইফুজ্জামান ঢাকার একটি সুপারশপে চাকরি করেন, মাসে মাত্র ১৪ হাজার টাকা বেতনে। এই সামান্য আয়ে তাঁর স্ত্রী-সন্তান, মা, বোনসহ ছয় সদস্যের সংসার কোনো রকম টানাপোড়েনের মধ্যে চলছিল। গ্রামের বাড়িতে সুমির ভাবি লাকি আক্তার (সাইফুজ্জামানের স্ত্রী) সেলাই মেশিনে কাজ করে সামান্য বাড়তি আয় করতেন। সেই সেলাই মেশিনটিও আগুনে পুড়ে গেছে। অগ্নিকাণ্ডের আকস্মিকতায় কিছুই রক্ষা করতে পারেননি তাঁরা।
সোমবার সকালে ওই গ্রামে গিয়ে দেখা যায় ভস্মীভূত ঘরের ভিটায় অসহায় অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছেন সুমির মা পারুল বেগম। পুড়ে যাওয়া মালপত্রে হাত বুলাচ্ছিলেন তিনি। চোখের সামনে তিলে তিলে গড়ে তোলা সংসার ছাই হয়ে যেতে দেখে নির্বাক পারুল বেগম অনেকটা বাকরুদ্ধ। তাঁর চোখে গভীর অনিশ্চয়তা। কারণ, আগুনে পুড়ে যাওয়া পরিবারের এখন নেই মাথা গোঁজার ঠাঁই, নেই ন্যূনতম খাবারের নিশ্চয়তা।
সুমির ভাবি লাকি আক্তার বললেন, ‘আমাদের সংসারে অভাব ছিল, কিন্তু শান্তির কমতি ছিল না। খেয়ে না খেয়ে সবাই একসঙ্গে ছিলাম। সেলাইয়ের কাজ করে সামান্য আয় হতো, তা সংসারের টানাপোড়েনে কিছুটা জোগান দিতাম, সুমির পড়ার খরচ দিতাম। কিন্তু নিমিষেই সব সম্বল হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছি আমরা। মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকুও আমাদের রইল না। কীভাবে যে আবার ঘর তুলব, সংসারটাকে টেনে তুলব, সুমির পড়াশোনারই কী হবে—কিছুই বুঝতে পারছি না।’
সুমি এসএসসি পাস করছে ২০২৩ সালে স্থানীয় একটি বিদ্যালয় থেকে। এরপর ভর্তি হয় বাড়ির কাছের ঝালকাঠি জেলার কাঁঠালিয়া উপজেলার আমুয়া শহীদ রাজা ডিগ্রি কলেজে। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা সামনে, অথচ এখন তার কাছে বই-খাতা তো দূরের কথা, রাত কাটানোর মতো একটি ঘর পর্যন্ত নেই। পোড়া ভিটার ওপর দাঁড়ানো সুমির চোখে-মুখে গভীর অনিশ্চয়তা। মাথা নিচু করে সুমি বলল, ‘জানি না পড়াশোনাটা আমি চালিয়ে যেতে পারব কি না। আমার স্বপ্নটাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবে কি না, জানি না। কোনো কিছুই তো আমাদের অবশিষ্ট রইল না। গরিবের জীবন এভাবে কেন তছনছ হয়।’