টেকনাফের সেই ৩ লাশের পরিচয় শনাক্ত, তরুণীর মাধ্যমে ডেকে নিয়ে তাঁদের খুন করা হয়

কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার দমদমিয়া এলাকার গহিন পাহাড় থেকে উদ্ধার অর্ধগলিত তিনটি লাশের পরিচয় শনাক্ত করেছেন পরিবারের সদস্যরা। আজ বৃহস্পতিবার সকালে টেকনাফ মডেল থানায় পৌঁছে লাশের পরিচয় শনাক্ত করেন তাঁরা। বিকেলে কক্সবাজার সদর হাসপাতালের মর্গে ময়নাতদন্ত সম্পন্ন এবং ডিএনএর নমুনা সংগ্রহের পর লাশগুলো স্বজনের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় র‌্যাব ও পুলিশ দমদমিয়া পাহাড়ে যৌথ অভিযান চালিয়ে তিন ব্যক্তির অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করে। নিহত ব্যক্তিরা হলেন কক্সবাজারের ঈদগাঁও উপজেলার জালালাবাদ ইউনিয়নের সওদাগর পাড়ার (বর্তমান কক্সবাজার শহরের মধ্যম বাহারছড়া) কবির আহমদের ছেলে মোহাম্মদ ইউসুফ, চৌফলদণ্ডী ইউনিয়নের উত্তরপাড়ার মোহাম্মদ আলমের ছেলে জমির হোসেন এবং কক্সবাজার শহরের উত্তর নুনিয়াছটার মোহাম্মদ ইব্রাহিমের ছেলে মোহাম্মদ ইমরান।

সকাল ৯টার দিকে টেকনাফ থানা প্রাঙ্গণে নিহত জমির হোসেনের পরিচয় শনাক্ত করেন তাঁর বড় বোন মিনু আরা বেগম। তিনি বলেন, ভাইয়ের চেহারা বিকৃত হলেও পরনের কালো প্যান্ট দেখে জমিরকে শনাক্ত করেন তিনি।

একইভাবে পরনে সাদা পাঞ্জাবি দেখে ইমরানকে শনাক্ত করেন তাঁর স্ত্রী ময়না বেগম। কালো প্যান্ট ও গেঞ্জি দেখে নিহত ইউসুফকে শনাক্ত করেন তাঁর স্ত্রী সাজেদা।
এ প্রসঙ্গে টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আবদুল হালিম প্রথম আলোকে বলেন, অর্ধগলিত লাশের সঙ্গে থাকা কাপড়চোপড় এবং আলামত দেখে স্বজনেরা জমির হোসেন, ইমরান ও ইউসুফের পরিচয় শনাক্ত করেন। কক্সবাজার সদর হাসপাতাল মর্গে বিকেলে ময়নাতদন্ত শেষে এবং ডিএনএ নমুনা সংগ্রহের পর লাশগুলো তাঁদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

তরুণীর মাধ্যমে ডেকে নিয়ে তিন বন্ধুকে হত্যা

পুলিশ, ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, টেকনাফের বাহারছড়ায় গত ২৮ এপ্রিল পাত্রী দেখতে গিয়ে তিন বন্ধুর অপহরণের ঘটনা সত্য নয়। সেখানকার এক তরুণী পরিকল্পিতভাবে তিনজনকে ঘটনাস্থলে ডেকে নিয়ে আটকে রাখেন। তরুণীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন জাহাঙ্গীর, কালু, বাবুল, হামিদ, ইসমাইল নামের স্থানীয় আরও কয়েকজন যুবক।

জমিরের বড় বোন মিনু আরা বেগম বলেন, টেকনাফ সদর ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের রাজারছড়া গ্রামের আবদুস সালামের মেয়ে কহিনুরের সঙ্গে তাঁর ভাই জমির হোসেনের পূর্ব থেকে পরিচয় ছিল। কহিনুর বেশির ভাগ সময় শহরের মোহাজের পাড়াতে থাকেন। ২৮ এপ্রিল জমিরকে কহিনুর ফোন করে রাজারছড়ার বাড়িতে যেতে বলেন। জমির তাঁর দুই বন্ধু ইমরান ও ইউসুফকে সঙ্গে নিয়ে একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশায় চড়ে বিকেল চারটায় ঘটনাস্থলে পৌঁছান। এরপর কহিনুরের লোকজন দিয়ে তিন বন্ধুকে আটকে রেখে ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেন। তাতে ব্যর্থ হলে কহিনুরের লোকজন তিন বন্ধুকে অন্য একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর কাছে ১০ লাখ টাকায় বিক্রি করে দেন।

মিনু আরা বলেন, এ ঘটনায় তিনি ১০ মে টেকনাফ মডেল থানায় কহিনুরসহ উল্লেখিত ছয়জনকে এজাহারনামীয় আসামি করে অজ্ঞাতনামা আরও ছয়-সাতজনের বিরুদ্ধে তিনি বাদী হয়ে একটি মামলা করেন।

মামলার এজাহারে বলা হয়, ২৮ এপ্রিল বেলা আড়াইটার দিকে জমির স্থানীয় আবদুল গফুরের অটোরিকশায় টেকনাফে রাজারছড়ার কহিনুরের বাড়িতে যাওয়ার কথা বলে ঘর থেকে বের হন। সঙ্গে দুই বন্ধু ইমরান ও ইউসুফ। বিকেল চারটার দিকে তিন বন্ধু কহিনুরের বাড়িতে পৌঁছালে আসামিরা তাঁদের জিম্মি করে আটকে রাখেন। পরের দিন ২৯ এপ্রিল বেলা ১১টার সময় জমিরের মুঠোফোন থেকে তাঁকে (মিনু) কল দিয়ে বলা হয় তিনজনকে অপহরণের কথা। তখন মুক্তিপণ হিসেবে ৩০ লাখ টাকা চাওয়া হয়। এ সময় ভাইসহ অন্যদের নির্যাতনের ভিডিওচিত্র তাঁর মুঠোফোনে পাঠানো হয়। বলা হয়, মুক্তিপণের টাকা না পাঠালে তিনজনকে হত্যা করে লাশ গুম করা হবে।

টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আবদুল হালিম বলেন, ১৩ মে পুলিশ ঘটনার সঙ্গে জড়িত শফিউল আলম প্রকাশ বেলাল (২৮) ও আরাফাত (২২) নামের দুই রোহিঙ্গাকে গ্রেপ্তার করে। এ সময় একজনের কাছ থেকে অপহৃত জমিরের মুঠোফোন উদ্ধার করা হয়। অন্যদিকে র‌্যাব সদস্যরা অপহরণকারী চক্রের দুই সদস্যকে গ্রেপ্তার করেন। তাঁদের দেওয়া স্বীকারোক্তি মতে গতকাল টেকনাফের পাহাড়ে অভিযান চালিয়ে তিনজনের অর্ধগলিত মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।

র‌্যাব-১৫ কক্সবাজারের অধিনায়ক লে. কর্নেল সাইফুল ইসলাম বলেন, বুধবার হাবিবছড়া গহিন পাহাড় থেকে অভিযান চালিয়ে র‌্যাব গ্রেপ্তার করে অপহরণকারী চক্রের প্রধান ছৈয়দ হোসন ওরফে সোনালী ডাকাত ও এমরুলকে। তাঁদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী তাঁদের সঙ্গে নিয়ে দমদমিয়া এলাকার গহিন পাহাড় থেকে তিন বন্ধুর লাশ উদ্ধার করা হয়। লাশ নিশ্চিহ্ন করতে সন্ত্রাসীরা আগুন ধরিয়ে দেয়।