কারাম উৎসবে মাতোয়ারা মহাদেবপুর, গোমস্তাপুরের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী সম্প্রদায়

নওগাঁর মহাদেবপুরে কারাম উৎসব উপলক্ষে সাংস্কৃতিক মিলনমেলা ও আদিবাসী সম্মেলনে নিজ নিজ সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি তুলে গান ও নাচ পরিবেশন করে ১০৭টি সাংস্কৃতিক দল। আজ রোববার বিকেলে মহাদেবপুর ডাকবাংলো মাঠে
ছবি: প্রথম আলো

নওগাঁর মহাদেবপুর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলায় বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের কারাম বৃক্ষের ডাল পূজাকে কেন্দ্র করে কারাম উৎসব হয়েছে। এর মধ্যে গোমস্তাপুরের পার্বতীপুর ইউনিয়নের শেরপুর গ্রামে উৎসবটি হয়েছে প্রায় অর্ধশতাব্দী পর।

আজ রোববার মহাদেবপুর উপজেলার সদর ডাকবাংলো মাঠে উৎসবটি উপলক্ষে আদিবাসী সম্মেলন ও সাংস্কৃতিক মিলনমেলার আয়োজন করা হয়েছে। অনুষ্ঠানে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী তরুণ-তরুণীরা রঙিন সাজে সেজে বাদ্যের তালে নেচে গেয়ে কারাম উৎসব উদ্‌যাপন করেন। অনুষ্ঠান উপভোগ করেন হাজারো মানুষ।

সমতলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষেরা গ্রামে গ্রামে কারাম বৃক্ষের (খিল কদম) ডাল পূজাকে কেন্দ্র করে এই উৎসবের আয়োজন করেন। ধর্মীয় বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান পালনের মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তার কাছে মনের কামনা-বাসনা পূরণের লক্ষ্যে প্রার্থনা করেন তাঁরা। এ ছাড়া নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতি আন্দোলনের অংশ হিসেবে বেশ কয়েক বছর ধরে জাতীয় আদিবাসী পরিষদসহ ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর বিভিন্ন সংগঠনগুলো এই পূজাকে ঘিরে নওগাঁর বিভিন্ন অঞ্চলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও সম্মেলনের আয়োজন করে আসছে।

দুই দিনব্যাপী এই উৎসবের প্রথম দিন গতকাল শনিবার দুই উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে বিভিন্ন ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন করেন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী নর-নারী। গতকাল দিনভর উপোস ছিলেন তাঁরা। সন্ধ্যার পর কারামগাছের (খিল কদম) ডাল বেদিতে বসানোর পর শুরু হয় পূজা। এরপর তাঁরা দিয়াবাতি, ফলমূল ও নিজেদের বানানো পিঠা সজ্জিত ডালা বা থালা সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশে পূজার বেদিতে উৎসর্গ করেন। রাত একটু গভীর হলে শিশু ও কিশোর-কিশোরীরা গ্রামের পূজাস্থানে জড়ো হয়। সেখানে একজন পুরোহিত নতুন প্রজন্মের কাছে কিচ্ছা আকারে কারাম পূজার উদ্দেশ্য তুলে ধরেন। কিচ্ছা বলা শেষ হলে উপোস থাকা নারীরা পরস্পরকে খাবার খাইয়ে উপোস ভেঙে ফেলেন। পরে বেদিতে পুঁতে রাখা কারাম ডালের চারপাশ ঘুরে ঘুরে ঢাক-ঢোল ও মাদলের বাজনার তালে তালে নৃত্য পরিবেশন করেন আদিবাসী তরুণীরা।

কারাম উৎসব উপলক্ষে ওঁরাওদের নাচ-গান। গতকাল শনিবার চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার পার্বতীপুর ইউনিয়নের শেরপুর গ্রামে
ছবি: সংগৃহীত

গোমস্তাপুর উপজেলার পার্বতীপুর ইউনিয়নের শেরপুর গ্রামের নেতৃস্থানীয় বয়োবৃদ্ধ নাথু টপ্প্য প্রথম আলোকে বলেন, স্বাধীনতার পাঁচ বছর আগে শেষবারের মতো তাঁদের গ্রামে কারাম উৎসব হয়। এরপর দারিদ্র্যের কষাঘাতে, মাদল-বাঁশিসহ বাদ্যযন্ত্রের অভাবে কেউ আর উৎসব আয়োজনের উদ্যোগ নেননি। মাসখানেক আগে গ্রামের মোড়ল সোমরা টপ্প্য সবাইকে নিয়ে সভা করে কারাম উৎসব উদ্‌যাপনের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি জানান, গতকাল সন্ধ্যায় কারাম উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়। কিন্তু দীর্ঘদিন পর কারামের গীত গাইতে ও নাচতে পেরে থামতে চাননি বয়স্ক নারীরা। গতকাল গভীর রাত পর্যন্ত ও আজ দুপুরেও নাচ-গান চলে প্রবল উৎসাহে।

বহু বছর পর কারাম উৎসব হচ্ছে জেনে রাজশাহী শহর থেকে এসে দুই দিন ধরে শেরপুর গ্রামে অবস্থান করেছিলেন ওঁরাও সম্প্রদায়ের নেতা বঙ্গপাল সরদার (৪৮)। গতকাল দুপুরে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কারাম উৎসবটি ওঁরাওদের প্রধান উৎসব হলেও মুন্ডা, রাজোয়ারসহ আরও ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষেরা এ উৎসব পালন করেন। তাঁদের সব উৎসবই প্রকৃতিকে ঘিরে।

অন্যদিকে নওগাঁর মহাদেবপুরের ডাক বাংলো মাঠে সাংস্কৃতিক মিলনমেলায় মহাদেবপুর, নিয়ামতপুর উপজেলা ছাড়াও জেলার অন্যান্য উপজেলা এবং বাইরের জেলায় বসবাসরত ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী জনগোষ্ঠীর ১০৭টি সাংস্কৃতিক দলগুলো অংশ নেয়। দলগুলো ডাক বাংলো মাঠে নিজ নিজ জাতিগোষ্ঠীর ঐতিহ্য তুলে ধরে ঢাক-ঢোল, মাদল ও করতালের (ঝুমকি) তালে তালে নাচ ও গান পরিবেশন করে।