সেই ব্যথাটা এখনো বহন করে নিয়ে যাচ্ছি: শহীদজায়া মাসতুরা

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বুধবার সকালে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। সেখানে বক্তব্য দেন মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক শহীদ মীর আবদুল কাইয়ূমের স্ত্রী মাসতুরা খানম
ছবি : প্রথম আলো

‘এত কষ্ট করে দেশটা স্বাধীন হলো। কিন্তু তারপরে কী দেখলাম? তারপরে তো আরও করুণ। যারা এ সমস্ত কাজ করেছে, ইন্ধন দিয়েছে, তারা কী করেছে। তারা অনেকেই জেলখানায় গিয়েছে। জানি না, কোন রহস্যে তারা আবার বেরিয়েছে। তারা পুনর্বাসিত হয়েছে, চাকরি করেছে, অবসরে চলে গেছে। এটা কী দেখেছি, এটা কী! এই দেখাটা কত কষ্টের দেখা। সেই দেখাটাই আমি দেখেছি এবং সেই ব্যথাটা এখনো বহন করে নিয়ে যাচ্ছি।’

আজ বুধবার সকালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের আয়োজনে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। সেখানে এসব আক্ষেপের কথা বলেন মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক শহীদ মীর আবদুল কাইয়ূমের স্ত্রী মাসতুরা খানম (৮১)। মাসতুরা খানমও বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। তাঁদের মেয়ে মাহবুবা কানিজ বর্তমানে ওই বিভাগের চেয়ারম্যান।

মীর আবদুল কাইয়ূমকে ১৯৭১ সালের ২৫ নভেম্বর তুলে নিয়ে যায় পাকিস্তানি সেনারা। রাজশাহী শহর থেকে তাঁকেসহ মোট ১৪ জনকে নিয়ে যাওয়া হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ৩০ ডিসেম্বর পদ্মা নদীর পাড়ে একটি গণকবর থেকে তিনিসহ ১৪ জনের লাশ এক রশিতে বাঁধা অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। তাঁদের গায়ে কোনো বুলেটের চিহ্ন ছিল না।

মাসতুরা খানম বলেন, ‘হয়তো এটাই আমার প্রথম এবং শেষ দাঁড়ানো। আমি আপনাদের আজকে এইটুকুই জানালাম শুধু। এইটুকু আপনারা জেনে থাকেন। এই কথা বলার শেষ নেই। কথা বলে মনে হচ্ছে, আমি একটু দায়মুক্ত হলাম। একটু হালকা হলাম। জানতে তো হবেই। আপনারা জেনে ছেলে-মেয়েদের জানাবেন। ইতিহাস তো মুছে দেওয়া যায় না। ইতিহাসকে রাখতে হবে আমাদের। সেই চিন্তাধারা, আদর্শ এগুলোকে যদি আমরা মুছে ফেলে দিই, তাহলে তো কিছুই থাকল না।’

আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন কমিটির সভাপতি সহ-উপাচার্য মো. হুমায়ুন কবীর। আরও বক্তব্য দেন উপাচার্য গোলাম সাব্বির সাত্তার, সহ-উপাচার্য মো. সুলতান-উল-ইসলাম, কোষাধ্যক্ষ মো. অবায়দুর রহমান প্রামাণিক প্রমুখ। আলোচনা সভা পরিচালনা করেন রেজিস্ট্রার মো. আবদুস সালাম।

শহীদ মীর আবদুল কাইয়ূমের স্ত্রী অধ্যাপক মাসতুরা খানম বক্তব্য দিচ্ছেন
ছবি: সংগৃহীত

সভায় ১৯৭১ সালের উত্তাল দিনগুলোর কথা বলেন মাসতুরা খানম। সে সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো শিক্ষার্থী ছিলেন না। তবে শিক্ষকদের নিয়মিত যেতে হতো বিভাগে। ওই সময়ে মনোবিজ্ঞান বিভাগের বেশির ভাগ শিক্ষক ছিলেন অবাঙালি। তাঁরা পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতা করতেন। তাঁদের বিভাগ ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারের তৃতীয় তলায়। সে সময় বাঙালি শিক্ষকেরা ‘জানটা হাতে নিয়ে’ থাকতেন। সেটা যে কী বিব্রতকর অবস্থা, কেউ ধারণা করতে পারবেন না। মনোবিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি মতিউর রহমানসহ এই বিশ্ববিদ্যালয়ে যাঁরা পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতা করতেন, তাঁরা সেখানে আড্ডা দিতেন। সেখানে যাওয়ার কোনো উপায় ছিল না। তখন জোরে কথা বলাও যেত না। যখন তাঁরা কোনো কথা বলতেন, তখন পিয়ন এসে বলত ‘বাঙালি এসব গাদ্দার হে’। সে যে কী কষ্ট, কী জ্বালা, কী অপমান, সেটা বোঝানো যায় না। এভাবে প্রায় ৯ মাস কাটিয়েছেন তাঁরা।

স্বামী মীর আবদুল কাইয়ূম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিভাগে স্পষ্ট কথা বলতেন মীর আবদুল কাইয়ূম। সেখানে অনেকেই মানা করে বলতেন, ‘এভাবে বলবেন না, আশপাশে কেউ শুনবে।’ তো উনি বলতেন, না, দেশ স্বাধীন হবে। উনি হয়তো দেখে যেতে পারবেন না। এ কথা সব সময় তিনি বলতেন।

শহীদদের নিয়ে রাজনীতি করা উচিত নয় জানিয়ে মাসতুরা বলেন, ‘যত দিন বাংলাদেশ থাকবে, ইতিহাস থাকবে, তত দিন আমরা শহীদদের ভুলব না। সবচেয়ে বড় কথা, শহীদরা রাজনীতির ঊর্ধ্বে, তাঁদের নিয়ে আমরা কোনো রাজনীতি করব না। রাজনীতি করা উচিত নয়। নিজের স্বার্থে ব্যবহার করা কখনোই উচিত নয়। ওনারা স্বার্থের অনেক ঊর্ধ্বে, রাজনীতির ঊর্ধ্বে, তাঁরা জীবন দিয়েছেন দেশের জন্য। শহীদ বুদ্ধিজীবীরা যে আদর্শ, ত্যাগ দিয়ে গেছেন, সেটা যেন আমরা মনে রাখি।’

আরও পড়ুন

সভায় উপাচার্য গোলাম সাব্বির সাত্তার বলেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী হত্যার উদ্দেশ্য ছিল বাঙালির স্বাধীনতার স্পৃহাকে স্তিমিত করা। তাই ইয়াহিয়া খান বেলুচিস্তানের কসাই টিক্কা খান ও রাও ফরমান আলীকে এখানে পাঠিয়েছিলেন। তাঁরা পরিকল্পিতভাবে বাঙালিকে মেধাশূন্য করতে বেছে বেছে বুদ্ধিজীবীদের নির্মমভাবে হত্যা করেছেন। বিশ্বের কোথাও এমন হত্যার নজির নেই। এই হত্যাযজ্ঞে সহযোগিতা করেছিলেন এ দেশি দোসররা।

এদিকে দিবসের প্রথম প্রহর থেকে প্রশাসন ভবনসহ অন্য ভবনে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়। সকাল ৮টায় উপাচার্য ও প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিফলকে এবং শহীদ মিনার ও বধ্যভূমি স্মৃতিস্তম্ভে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ সিনেট ভবনে অনুষ্ঠিত হয় স্মৃতিচারণা ও সম্মাননা স্মারক প্রদান।

দিবস উপলক্ষে বাদ জোহর কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে বিশেষ মোনাজাত ও সন্ধ্যায় কেন্দ্রীয় মন্দিরে বিশেষ প্রার্থনা হবে। সন্ধ্যায় শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিফলক চত্বরে প্রদীপ প্রজ্বালন, সন্ধ্যা ৬টায় কৌশিক সরকারের নির্দেশনা এবং সুমনা সরকারের গ্রন্থনা ও অভিনয়ে নাটক ‘জয়জয়িতা’ মঞ্চায়ন হবে।

আরও পড়ুন