৩৬ গ্রামে সবজি চাষে বিপ্লব

ঝালকাঠি সদর উপজেলায় বছরে ৫৬ হাজার ৬০০ মেট্রিক টন সবজি উৎপাদন করা হয়। ৩৬ গ্রামের নারীরাই এ সবজি উৎপাদনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন।

ঝালকাঠি সদর উপজেলার কাপড়কাঠি গ্রামের সবজিখেতে গাছের পরিচর্যা করছেন এক নারী। সম্প্রতি তোলা ছবিছবি: প্রথম আলো

খেতে পানি দেওয়া, চারা লাগানো, আগাছা পরিষ্কার, ফসল তোলাসহ সব ধরনের কাজ করছেন নারীরা। তাঁদের হাতের ছোঁয়ায় ফলছে ফুলকপি, বাঁধাকপি, মুলা, লাউ, শিমসহ নানা সবজি। এভাবে ঝালকাঠি সদর উপজেলার ৩৬টি গ্রামের নারীরা সবজি চাষে বিপ্লব ঘটিয়েছেন। সবজি চাষ করে পাঁচ হাজার পরিবারের অভাব দূর হয়েছে।

ঝালকাঠি সদরের শাখাগাছি গ্রামের লক্ষ্মী হালদার। একসময় বিভিন্ন এনজিও ও মহাজনদের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়েছিলেন। কীভাবে ঋণের টাকা পরিশোধ করবেন, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলেন। পাঁচ বছর আগে স্বামীর সঙ্গে আগাম শীতকালীন সবজি চাষ শুরু করেন। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁদের। সঠিক পদ্ধতিতে সকজি চাষ করে লাভের মুখ দেখতে শুরু করেন। ঋণের অধিকাংশ টাকা শোধ করে ফেলেছেন। এবার লাউ ও আগাম শীতকালীন সবজি বিক্রি করে প্রায় পাঁচ লাখ টাকা আয় করেছেন।

সবজি চাষ করে সংসারে সচ্ছলতা ফিরে আসায় খুব খুশি লক্ষ্মী হালদার। তিনি বলেন, ‘শীতকালীন সবজি উৎপাদন করে স্বামীর ঋণের টাকা পরিশোধ করেছি। শুধু আমি নয়, আমাদের এলাকার অনেক নারী স্বাবলম্বী হয়েছেন।’

সবজি চাষে যুক্ত নারীদের স্বামীরা সংসারে বাড়তি আয় হওয়ায় অনেকটা স্বস্তিতে আছেন। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন বলেন, তাঁদের স্ত্রীরা খেত সামলে আবার সংসারের রান্নাবান্নাসহ ছেলেমেয়েদের দেখাশোনার দায়িত্বও পালন করেন। অনেক সময় নৌকায় সবজি বাজারে নিয়ে বিক্রিও করেন। সব কাজে পুরুষেরা পাশে থেকে তাঁরা সাহায্য করেন।

সদর উপজেলা কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, সদর উপজেলায় রবি মৌসুমে ৩ হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে ৪৩ হাজার ৪০০ মেট্রিক টন সবজি উৎপাদন হয়। গ্রীষ্ম মৌসুমে ২ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে ১৩ হাজার ২০০ মেট্রিক টন সবজি উৎপাদন হয়। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে এসব সবজি দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হয়। ৩৬ গ্রামের নারীরাই এ সবজি উৎপাদনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। এখানে মাঠ থেকে উৎপাদিত সবজি সরাসরি ভোক্তাদের কাছে বিক্রির ব্যবস্থাও রয়েছে। সদরে কৃষি কার্যালয়ের তত্ত্বাবধানে বাজার সংগঠন প্রকল্পের (আইএফএমসি) পাঁচটি স্কুল আছে। স্কুলের প্রতিটি দলে ২৫ জন পুরুষ ও ২৫ জন নারী সদস্য রয়েছেন। দলের উৎপাদিত সবজি সরাসরি ভোক্তাদের কাছে বিক্রি হয়।

গত শুক্রবার সকালে কীর্ত্তিপাশা, পোনাবালিয়া, ভীমরুলি, ডুমুরিয়া, পশ্চিম ভাওতিতা, বাউকাঠিসহ ১৫টি গ্রামের গিয়ে দেখা যায়, নারীরা সবজিখেতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। কেউ সবজি তুলছেন, কেউ আগাছা পরিষ্কার করছেন। কেউ কোদাল দিয়ে জমি ঠিক করছেন।

সবজি চাষে নারীদের সাফল্যের প্রশংসা করছেন উপজেলা কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারাও। সঠিকভাবে সবজি উৎপাদন ও বাজারজাত করার জন্য তাদের নানা ধরনের প্রশিক্ষণও দেওয়া হচ্ছে।

স্থানীয় কয়েকজন কৃষক জানান, সদর উপজেলার ৩৬ গ্রামে উৎপাদিত শাকসবজি জেলার চাহিদা পূরণ করে ঢাকা ও বরিশালে সরবরাহ করা হচ্ছে। গুণগত মানে সেরা হওয়ায় চাহিদাও অনেক বেশি। প্রতিবছর সবজি বিক্রি করে এসব গ্রামের নারীরা ৩০ কোটি টাকা আয় করে। গড়ে প্রত্যেক নারীর পরিবার ১০ লাখ টাকা করে আয় করছে।

শতদশকাঠি গ্রামের কৃষক মনোরঞ্জন শীল (৫০) বলেন, ‘আমাদের গ্রামের নারীরা কঠোর পরিশ্রমী। পুরুষের পাশাপাশি তাঁরা মাঠে কাজ করে ফসল উৎপাদনে ব্যাপক সহায়তা করে।’

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, নারীদের প্রণোদনা ও পরামর্শ দেওয়াসহ নানাভাবে সহযোগিতা করা হচ্ছে। কৃষিক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ অর্থনীতির অবস্থা মজবুত করছে।