‘আদরের ভাইটিকে ওরা ছুরি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মেরেছে’

দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে নিহত তৌহিদুলের স্ত্রী সানজিদা আক্তার। আজ শুক্রবার সকালেছবি: প্রথম আলো

এক বছরের নাতনিকে কোলে নিয়ে আধভাঙা কাঁচা বসতঘরের দাওয়ায় বসে আহাজারি করছিলেন বৃদ্ধ ফিরোজা বেগম। বিলাপ করতে করতে বলছিলেন, ‘ও তৌহিদরে, কই গেলি রে বাপধন। আমার বুকের মানিকরে কারা কাইড়া নিল রে। আমার এতিম নাতি-নাতনিরে এখন কে দেখবে? আল্লাহ, তুমি এর বিচার করিও।’

 চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে খুন হওয়া পিকআপ ভ্যানের চালক তৌহিদুল ইসলামের (৩০) বাড়িতে গিয়ে আজ শুক্রবার সকালে এই দৃশ্য চোখে পড়ে। তৌহিদুলের মা ফিরোজা বেগম যখন বিলাপ করছিলেন, তখন উঠানজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে আছেন স্বজন ও প্রতিবেশীরা।

 গত বুধবার রাতে বাড়ির পাশে খুন হন তৌহিদুল ইসলাম। তিনি মিরসরাই উপজেলার হিঙ্গুলী ইউনিয়নের দক্ষিণ আজমপুর গ্রামের মৃত আবুল হাসেমের ছেলে। তৌহিদুলকে কুপিয়ে খুন করার পর গলায় বেল্ট পেঁচিয়ে লাশ রেললাইনের সঙ্গে বেঁধে রেখে যায় খুনিরা।

দক্ষিণ আজমপুর গ্রামের জরাজীর্ণ একটি কাঁচা বসতঘরে মা ফিরোজা বেগম, স্ত্রী সানজিদা আক্তার এবং চার বছর বয়সী এক ছেলে ও এক বছর বয়সী মেয়েকে নিয়ে বসবাস করতেন তৌহিদুল ইসলাম। আজ সকালে নিহত তৌহিদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, মূল ঘরের পেছনে ছাউনি ছাড়া ছোট একটি রান্নাঘর। তার পাশে থাকা শৌচাগারটিতেও ঠিকমতো বেড়া নেই। ঘরে আসবাব বলতে কেবল একটি পুরোনো খাট আর একটি আলনা। আলনায় কিছু জামা ঝুলছিল। পুরো ঘরজুড়ে দারিদ্র্যের ছাপ।

 পরিবারের লোকজন ও স্বজনেরা জানান, তৌহিদের বাবা আবুল হাসেম ছিলেন গাড়িচালক। তাঁর হাত ধরে বড় ছেলে সাইফুল ইসলামও নিজেকে জড়ান চালকের পেশায়। সাইফুল গাড়ি চালানো শেখান তৌহিদুলসহ ছোট তিন ভাইকে। আবুল হাসেমের মৃত্যুর পর এখন তাঁর চার ছেলে সবাই গাড়ি চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন।

 তৌহিদুল ইসলাম নিজের গাড়ি না থাকায় অন্যের গাড়ি ভাড়া নিয়ে চালাতেন। সব সময় ভাড়া না পাওয়ায় কষ্টে সংসার চালাতে হতো তাঁকে। নানা সময় আর্থিক অনটনে পড়ে তিনটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা থেকে ঋণ নিয়েছিলেন তৌহিদুল। প্রতি সপ্তাহে ১ হাজার ২০০ টাকা করে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হচ্ছিল তাঁকে।

 বাড়িতে কথা হয় তৌহিদুলের বড় ভাই সাইফুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ১৭ বছর আগে তাঁদের বাবা মারা যান। পরিবারে অভাব থাকলেও তিনি ভাইদের কখনো বুঝতে দেননি। পড়াশোনায় মনোযোগ না থাকায় সঙ্গে রেখে গাড়ি চালানো শিখিয়েছিলেন তৌহিদুলকে। বিয়ের পর আলাদা থাকলেও মায়া-মমতার কমতি ছিল না ভাইদের মধ্যে।

 সাইফুল ইসলাম আরও বলেন, ‘আমার ভাইটিকে ওরা ছুরি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মেরেছে। ভাইয়ের শরীরের ক্ষতচিহ্ন কী করে ভুলব?’

 ছেলে আর মেয়েকে পাশে বসিয়ে ঘরের ভেতর ফুপিয়ে কাঁদছিলেন তৌহিদুলের স্ত্রী সানজিদা আক্তার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অভাব-অনটন থাকলেও তাঁদের ছিল সুখের সংসার। বুধবার রাতে একই গ্রামের এক ব্যক্তি ফোন করে কোনো এক স্থান থেকে গাড়িতে করে খারাপ জিনিস (মাদক) এনে দিতে বলেন তাঁর স্বামীকে। স্বামী তৌহিদুল পারবেন না বলে ফোন বন্ধ করে রাখেন। কিছু সময় পর ফোন খুললে পূর্বপরিচিত আরেকজন ফোন করে ডেকে তাঁর স্বামীকে একটি গায়েহলুদের অনুষ্ঠানে নিয়ে যান। রাত সাড়ে নয়টায়ও ফোনে কথা হয় স্বামীর সঙ্গে।

সানজিদা আক্তার বলেন, ‘রাত সাড়ে নয়টায় যখন কথা হয়, তখন তিনি আমাদের খাওয়াদাওয়া করে ঘুমিয়ে পড়তে বলেন। রাত একটায়ও ঘরে না আসায় আবার ফোন করি। তখন ওনার ফোন বন্ধ পাই। সকালবেলা রেললাইনের ওপর ওনার লাশ পাওয়া যায়। মাদক কারবারিরা আমার স্বামীকে হত্যা করেছে। ওরা আমার ছেলে-মেয়েদের এতিম করে দিল। আমার ছেলে-মেয়েদের এখন কে দেখবে?’

জানতে চাইলে জোরারগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবদুল্লা আল হারুন প্রথম আলোকে বলেন, পিকআপচালক তৌহিদুল ইসলাম হত্যার ঘটনায় জোরারগঞ্জ থানায় তাঁর স্ত্রী বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে, মাদকসংক্রান্ত কারণে এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় শুক্রবার তিনজনকে আটক করা হলেও তাঁদের মধ্যে একজনকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি পুলিশ খতিয়ে দেখছে।