উদ্বোধনের অপেক্ষায় দুই ভাস্কর্য

ভাস্কর্য দুটি নির্মাণ করেছেন গাজীপুরের বাড়ীয়ার সন্তান ভাস্কর কুয়াশা বিন্দু। ১৯ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হবে।

গাজীপুর শহরের প্রাণকেন্দ্রে নির্মিত হয়েছে ভাস্কর্য ‘সশস্ত্র প্রতিরোধ’
প্রথম আলো

গাজীপুরে মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসংবলিত দুটি ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রতিরোধ দিবসের স্মৃতি স্মরণে ‘সশস্ত্র প্রতিরোধ’ নামে একটি ভাস্কর্য করা হয়েছে শহরের মুক্ত মঞ্চে। অপরটি সদর উপজেলার বাড়ীয়া গ্রামে। এটির নাম ‘বাড়ীয়া গণহত্যা’। ভাস্কর্য দুটি এখন আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধনের অপেক্ষায়। মুক্তিযুদ্ধবিষয়বক মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে দুটি ভাস্কর্য স্থাপনের কাজ বাস্তবায়ন করেছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। ভাস্কর্য দুটি নির্মাণ করেছেন গাজীপুরের বাড়ীয়ার সন্তান ভাস্কর কুয়াশা বিন্দু। 

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নতুন প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করতে গাজীপুরের সংস্কৃতিকর্মীরা দীর্ঘদিন ধরে শহরে ও বাড়ীয়া গ্রামের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসংবলিত দুটি ভাস্কর্য স্থাপনের দাবি জানিয়ে আসছিলেন। 

গাজীপুর শহরের বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা হাতেম আলী বলেন, ‘গণহত্যার মাধ্যমে হানাদার বাহিনী তাদের নির্মমতা দেখিয়েছে। আমরা যুদ্ধ করে মোকাবিলা করেছি। মুক্তিযুদ্ধের চিহ্ন ধরে রাখতে গাজীপুর শহরের মুক্ত মঞ্চে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রতিরোধ দিবসের স্মৃতিসংবলিত ভাস্কর্য সশস্ত্র প্রতিরোধ ও বাড়ীয়ায় ‘বাড়ীয়া গণহত্যা’ ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে, যা পরবর্তী প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে শিক্ষা নেওয়ার সুযোগ করে দেবে।’

এ বিষয়ে গাজীপুরে এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী মো. কামরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সশস্ত্র প্রতিরোধ’ ও ‘বাড়ীয়া গণহত্যা’ দুটি ভাস্কর্যের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। ১৯ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হবে।

সশস্ত্র প্রতিরোধ ভাস্কর্য 

ভাস্কর্যের ফলকে লেখা বর্ণনা এবং জেলার কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে একাত্তর সালের ১৯ মার্চ একটি অবিস্মরণীয় দিন। এদিন জয়দেবপুরবাসী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হন। অসম এই যুদ্ধে জয়দেবপুরে মনু খলিফা, কিশোর নিয়ামত ও চান্দনা চৌরাস্তায় ফুটবলার হুরমত শহীদ হন। আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ শুরু হওয়ার সাত দিন আগে জয়দেবপুরের এই প্রতিরোধ সারা দেশে মুক্তিকামী জনতাকে দারুণভাবে উজ্জীবিত করে। সারা দেশে স্লোগান ওঠে ‘জয়দেবপুরের পথ ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো।’ এই সশস্ত্র প্রতিরোধের খবর আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম গুরুত্বের সঙ্গে পরিবেশন করে। তখন চলমান বঙ্গবন্ধু-ইয়াহিয়ার বৈঠকেও ১৯ মার্চের প্রতিরোধ সংগ্রামের ঘটনা আলোচনায় স্থান পায়। 

১৯ মার্চের প্রতিরোধে নেতৃত্ব দেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আ ক ম মোজাম্মেল হক, যিনি বর্তমান সরকারের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ১৯ মার্চ আকস্মিকভাবে পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার জাহানজেবেরের নেতৃত্বে পাকিস্তানি রেজিমেন্ট বাঙালি সৈন্যদের নিরস্ত্র করতে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে পৌঁছান। সংগ্রাম পরিষদের নেতারা এ খবর মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি, ডিজেল প্ল্যান্ট ও সমরাস্ত্র কারখানার শ্রমিকদের কাছে পৌঁছে দেন। এক ঘণ্টার মধ্যে হাজারো শ্রমিক, জনতা লাঠিসোঁটা, দা, কাতরা, ছেনি, দোনলা বন্দুকসহ জয়দেবপুরে হাজির হন। শ্রমিক-জনতা জয়দেবপুর রেলগেটে মালগাড়ির বগি, স্লিপার, গাছের  বড় বড় গুঁড়ি, কাঠ, বাঁশ, ইট দিয়ে স্তূপ বানিয়ে প্রতিবন্ধক তৈরি করেন। জয়দেবপুর থেকে চৌরাস্তা পর্যন্ত মোট পাঁচটি ব্যারিকেড দেওয়া হয়। 

এ সময় টাঙ্গাইল থেকে রেশন নিয়ে একটি কনভয় জয়দেবপুরে এসে ব্যারিকেডে আটকে পড়ে। জনতা কনভয়ের সৈনিকদের পাঁচটি চায়নিজ রাইফেল ছিনিয়ে নেয়। ব্যারিকেডে আটকে পড়া জাহানজেব জনতাকে উদ্দেশ করে গুলির নির্দেশ দেন। আন্দোলনরত সশস্ত্র জনতা বর্তমান গাজীপুর শহরের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে অবস্থান নিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের লক্ষ্য করে পাল্টা গুলি ছোড়েন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গুলিতে বেশ কয়েকজন আন্দোলনকারী হতাহত হন। পাকিস্তানি বাহিনী কার্ফু জারি করে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করলে জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। পরে দীর্ঘ সময় ধরে ব্যারিকেড সরিয়ে জাহানজেব বাহিনী অগ্রসর হয়ে চান্দনা চৌরাস্তায় এসে বাধার মুখে পড়ে। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে ১৯ মার্চ ’৭১ একটি মাইলফলক হয়ে আছে। ১৯ মার্চের বীরগাথা স্মরণে নির্মিত হয়েছে এই ‘সশস্ত্র প্রতিরোধ' ভাস্কর্য। 

গাজীপুরের সদর উপজেলার বাড়ীয়া গ্রামে ভাস্কর্য ‘বাড়ীয়া গণহত্যা’
ছবি: প্রথম আলো

বাড়ীয়া গণহত্যা 

১৯৭১ সালের ১৪ মে বিকেলে প্রায় ৫০০ পাকিস্তানি সেনার একটি দল ভাওয়াল এস্টেটের বাড়ীয়ায় প্রবেশ করে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং গ্রামবাসীর ওপর গুলি চালায়। অনেকে ঘটনাস্থলেই মারা যান। পালিয়ে যাওয়া গ্রামবাসীর জিনিসপত্র পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং তাদের সহযোগীরা লুট করে নিয়ে যায়। নির্বিচার গোলাগুলির ঘটনায় বাড়ীয়া এবং পাশের কামারিয়ার গ্রামের দেড় শতাধিক মানুষ মারা যায়।  

গাজীপুরের বীর মুক্তিযোদ্ধারা বলেন, যুদ্ধের পর বাড়িয়া ও কামারিয়া গ্রামে ১৫১ শহীদের তালিকা করা হলেও শহীদের সংখ্যা আরও অনেক বেশি। জয়দেবপুরের রাজবাড়িতে ক্যান্টনমেন্ট থাকায় পাকিস্তানি বাহিনী সহজেই তিতারকুল দিয়ে চিলাই নদী পার হয়ে বাড়িয়ায় হত্যাযজ্ঞ চালাতে পেরেছে। ভাওয়াল রাজবাড়ি ক্যান্টনমেন্ট থেকে বাড়ীয়া গ্রামের দূরত্ব ছিল আট কিলোমিটার। পাকিস্তানি বাহিনী আসার কথা শুনে গ্রামবাসীর অনেকেই বাড়ি থেকে পালিয়ে বিলে নেমে যায়। কচুরিপানার মধ্যে শুধু মাথাটা বের করে দিয়ে কোনো রকমে লুকিয়ে ছিল। এর মধ্যে পাকিস্তানি বাহিনী গুলি করে। গুলিতে সেখানে অনেকেই মারা যান। 

গাজীপুরের দুটি ভাস্কর্যের শিল্পী কুয়াশা বিন্দু প্রথম আলোকে বলেন, ১৯ মার্চ গাজীপুরের  প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ শুরু হয়। সেই স্মৃতিচিহ্ন ধরে রাখতেই নির্মাণ করা হয়েছে সশস্ত্র প্রতিরোধ ভাস্কর্য। একজনের হাতে রাখা হয়েছে বন্দুক। শহীদদের স্মরণে একজনকে দেখানো হয়েছে গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে আছেন। অন্যরা যে যা পেরেছেন, তা–ই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। আর বাড়ীয়া গ্রামে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছিল। সেখানে মৃত দেখানো হয়েছে অনেককে। আবার অনেকে পানিতে লুকিয়ে ছিল। সেই সব ইতিহাসও তুলে ধরা হয়েছে।