মানিকগঞ্জে নারী হত্যা মামলায় দুজনকে মৃত্যুদণ্ড, মেয়ে ও প্রেমিককে যাবজ্জীবন

আদালত
প্রতীকী ছবি

মানিকগঞ্জ শহরে এক নারীকে হত্যার দায়ে দুই আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে ওই নারীর মেয়ে ও তাঁর প্রেমিককে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। আজ বুধবার দুপুরে সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ জয়শ্রী সমদ্দার এই রায় দেন।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের আড়াকুল এলাকার আবদুল বারেকের ছেলে রাকিব হোসেন (২৭) ও নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার পূর্ব গোলমুন্ডা গ্রামের মমিনুর রহমানের ছেলে মাহাফুজার রহমান (২৩)। মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি তাঁদের দুজনের প্রত্যেককে ২০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ড করা হয়েছে। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা হলেন ওই নারীর মেয়ে জুলেখা আক্তার ওরফে জ্যোতি (২২) ও তাঁর প্রেমিক শফিউর রহমান ওরফে নাঈম (২৮)। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের পাশাপাশি তাঁদের দুজনকে ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

আদালত-সংশ্লিষ্ট সূত্র এবং মামলার তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০২০ সালের ২২ জানুয়ারি সকালে মানিকগঞ্জ শহরের দক্ষিণ সেওতা এলাকার জহিরুল ইসলাম প্রাতর্ভ্রমণ শেষে বাসায় ফেরেন। এ সময় তাঁর মেয়ে জুলেখা আক্তার বাড়ির প্রধান ফটক খুলে দেন। এরপর তিনি বাড়ির পঞ্চমতলার ছাদে কবুতরের খাবার দিতে যান। পরে দ্বিতীয় তলার কক্ষে গিয়ে স্ত্রী মাহমুদা বেগমকে (৪৫) লেপ দিয়ে ঢাকা অবস্থায় দেখতে পান তিনি। স্ত্রীকে ডাকাডাকি করলেও সাড়া না দেওয়ায় লেপ ধরে টান দিলে তাঁকে নাকে রক্তসহ অচেতন অবস্থায় দেখতে পান। এরপর মাহমুদাকে হাসপাতালে নেওয়া হলে কতর্ব্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।

পরদিন জহিরুল ইসলাম তাঁর মেয়ে জুলেখা আক্তার, জুলেখার প্রেমিক শফিউর রহমান ও শফিউরের বন্ধু রাকিব হোসেনসহ অজ্ঞাতপরিচয় আরও দুজনকে আসামি করে সদর থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। এরপর পুলিশ ওই তিন আসামিকে গ্রেপ্তার করে। তাঁদের দেওয়া তথ্যমতে মাহফুজার রহমান ও নূর বক্সকে এই মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়। মামলাটি সদর থানার তৎকালীন উপপরিদর্শক (এসআই) শামীম আল-মামুন তদন্তের দায়িত্ব পান। একই বছরের ৩১ মে মামলা তদন্ত কর্মকর্তা ওই পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেন।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই শামীম আল-মামুন বলেন, হত্যাকাণ্ডের প্রায় তিন বছর আগে পারিবারিকভাবে ঢাকার ধামরাই উপজেলার গোলাকান্দা গ্রামের মারুফ হাসানের সঙ্গে মেয়ে জুলেখা আক্তারের বিয়ে হয়। বিয়ের দুই বছর পর ফেসবুকের মাধ্যমে শফিউর রহমানের সঙ্গে জুলেখা সম্পর্কে জড়িয়ে যান। একপর্যায়ে তাঁদের মধ্যে বিবাহবহির্ভূত সর্ম্পক গড়ে ওঠে। এ ঘটনায় ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে স্বামীর সঙ্গে জুলেখার বিবাহবিচ্ছেদ হলে তিনি দক্ষিণ সেওতা এলাকায় বাবার বাড়ি চলে আসেন। এরপরও মাঝেমধ্যে গোপনে শফিউল জুলেখার বাবার বাসায় যেতেন এবং জুলেখার সঙ্গে মেলামেশা করতেন। বিষয়টি জানতে পেরে জুলেখাকে শাসন করেন মা মাহমুদা। এই পরিস্থিতিতে দ্রুত সময়ের মধ্যে জুলেখাকে অন্যত্র বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে জুলেখা ও শফিউর মাহমুদাকে হত্যার পরিকল্পনা করেন।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পরিকল্পনা অনুযায়ী শফিউর অপর আসামিদের সঙ্গে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকার বিনিময়ে মাহমুদা আক্তারকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। হত্যাকাণ্ডের আগের দিন বিকেলে জুলেখার কক্ষে গিয়ে অবস্থান করেন শফিউরসহ অপর আসামিরা। সারা রাত জুলেখাসহ আসামিরা ওই কক্ষে অবস্থান করেন। হত্যাকাণ্ডের দিন সকালে জুলেখার বাবা প্রাতর্ভ্রমণ এবং বাজার করতে বের হলে আসামিরা মাহমুদার কক্ষে গিয়ে তাঁকে হাত-পা ও মুখ চেপে ধরেন। এরপর আসামিরা শ্বাসরোধ করে মাহমুদাকে হত্যা করে পালিয়ে যান।

মামলায় মোট ২৫ জন সাক্ষীর মধ্যে ২১ জন সাক্ষ্য দেন। সাক্ষীদের সাক্ষ্য এবং তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে ওই চার আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ জয়শ্রী সমদ্দার দুই আসামিকে মৃত্যুদণ্ড এবং অপর দুই আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। তবে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় আসামি নূর বক্সকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। রায় ঘোষণার সময় আসামিরা আদালতে উপস্থিত ছিলেন।

রাষ্ট্রপক্ষে মামলাটি পরিচালনা করেন জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) আবদুস সালাম। আসামিপক্ষে মামলা পরিচালনা করেন আমিনুল হক ও খন্দকার সুজন হোসেন।