কারচুপির গুঞ্জন থেকে পরাজিত দুই প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে উত্তেজনা

দিনাজপুরের বিরল উপজেলার সিঙ্গুলই হামিদ-হামিদা উচ্চবিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে গতকাল রোববার সহিংসতার ঘটনা ঘটেছবি: প্রথম আলো

দিনাজপুরের বিরল উপজেলার আজিমপুর ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে সিঙ্গুইল হামিদ-হামিদা উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে দুই সদস্য প্রার্থীর মধ্যে ব্যবধান ছিল ২০ ভোট। পরাজিত প্রার্থীর এজেন্টের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে পুনরায় ভোট গণনা করা হয়। ফলাফল আগের মতো হলেও পরাজিত প্রার্থীর সমর্থকেরা বিষয়টি মেনে নেননি।

এদিকে ফল ঘোষণায় দেরি হওয়ায় কেন্দ্রের বাইরে সমর্থকদের মধ্যে ভোট কারচুপির গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে চেয়ারম্যান পদের প্রার্থীদের সমর্থকেরাও উপস্থিত ছিলেন। ২৭৫ ভোটের ব্যবধানে চেয়ারম্যান পদের এক প্রার্থীকে জয়ী ঘোষণা করা হয়। তখন চেয়ারম্যান ও সদস্য পদে পরাজিত দুই প্রার্থীর সমর্থকেরা উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। একপর্যায়ে তাঁরা ওই কেন্দ্রে হামলা করেন। তখন পুলিশ গুলি চালায়। স্থানীয় লোকজন ও নির্বাচন সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

রোববার আজিমপুর ইউপিসহ বিরল উপজেলার তিন ইউপিতে ভোট গ্রহণ করা হয়। সুষ্ঠুভাবে ভোট গ্রহণ শেষ হলেও সিঙ্গুইল হামিদ-হামিদা উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে গন্ডগোল বাধে ফলাফল ঘোষণার শেষ মুহূর্তে। পরাজিত প্রার্থীর সমর্থকেরা ভোটের ফলাফল নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে নানা গুজব ছড়াতে থাকেন। একপর্যায়ে পুলিশের ওপর চড়াও হন জনতা। তখন পুলিশের গুলিতে নিহত হন মোহাম্মদ আলী (৬৭) নামের এক ব্যক্তি। তাঁর বাড়ি উপজেলার সিঙ্গুল ডাঙ্গাপাড়া গ্রামে। তিনি বিজয়ী ইউপি সদস্য জোবায়দুর রহমানের চাচা।

আজিমপুর ইউপির ১ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য পদের প্রার্থী ছিলেন চারজন। সিঙ্গুইল হামিদ-হামিদা উচ্চবিদ্যালয় ছিল ভোটকেন্দ্র। টিউবওয়েল প্রতীকের প্রার্থী জোবায়দুর রহমান পান ৫৯৭ ভোট এবং মোরগ প্রতীকে সাইফুল ইসলাম পান ৫৭৭ ভোট। গণনা শেষে প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ফলাফল শিটে পোলিং এজেন্টদের স্বাক্ষর চান। সাইফুল ইসলামের পোলিং এজেন্ট স্বাক্ষর দিতে রাজি হননি। তাঁর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আবার ব্যালট গণনা করা হয়।

এই ইউপিতে ৯টি কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ করা হয়। এদিকে ৮টি কেন্দ্রের ফলাফলে চেয়ারম্যান পদে আনারস প্রতীকের প্রার্থী লিটন মিয়া এগিয়ে ছিলেন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন মোটরসাইকেল প্রতীকের আল মামুন। সিঙ্গুইল হামিদ-হামিদা উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে ফলাফল জানতে দুই প্রার্থীর সমর্থকেরা সেখানে জড়ো হন। ফল ঘোষণার পর দেখা যায় ২৭৫ ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন লিটন মিয়া। তবে আল মামুন সমর্থকেরা বিষয়টি মেনে নেননি। ভোট গণনায় কারচুপির অভিযোগ এনে তাঁরা সহিংস প্রতিবাদ শুরু করেন।  

আজ সকাল সাড়ে নয়টায় চৌরঙ্গী বাজারে গিয়ে দেখা যায়, দু-একটি বাদে প্রায় দোকানপাট বন্ধ। চায়ের দোকানে বসে গতকালের ঘটনার কথা আলোচনা করছেন লোকজন। তাঁদেরই একজন রাজকুমার রায়। ভোটকেন্দ্রে পোলিং এজেন্টের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। তিনি বলেন, ভোট গ্রহণ ও গণনা নিয়ে কোনো সমস্যা হয়নি। সদস্য পদে মোরগ মার্কার প্রার্থীর এজেন্ট পুনরায় ভোট গণনার দাবি করেছিলেন। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবার ভোট গণনা করেছেন। ফল মেনেও নিয়েছেন সবাই। মাইকে ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু তারপরও সবাই কাগজ চায় (ফলাফল শিট)। চেয়ারম্যান পদের ফলাফলের কাগজ চায় লোকজন। পুলিশ দুবার ধাওয়া দিয়ে লোকজনকে সরিয়ে দিয়েছে। পরে গাড়ি নিয়ে বের হওয়ার সময় ইটপাটকেল ছুড়তে শুরু করে মানুষ। এর কিছু সময় পরই গুলি ছোড়ে পুলিশ।

রাজ কুমারের কথার সঙ্গে মিল পাওয়া যায় ওই কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ও বিরল উপজেলা রিসোর্স সেন্টারের ইনস্ট্রাক্টর মাহবুবুর রহমানের। মুঠোফোনে তিনি বলেন, ‘ভোট গণনা শেষ হয়েছে সন্ধ্যা ছয়টায়। পৌনে সাতটায় ফলাফল মাইকে ঘোষণা করা হয়। কেন্দ্র ত্যাগ করার জন্য সবাই গাড়ি নিয়ে বের হয়েছি। প্রথমে উত্তেজিত জনতা বিদ্যালয়ের প্রধান ফটক অবরুদ্ধ করে ইটপাটকেল ছুড়তে শুরু করে। পরে আমরা পিছিয়ে আসি। পুলিশ লাঠিপেটা করে তাদের সরিয়ে দেয়। দ্বিতীবার যখন বের হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছি, ঠিক সেই সময় প্রধান ফটক দিয়ে মানুষ ভেতরে প্রবেশ করে এবং ইটপাটকেল ছুড়তে থাকে। পরে প্রশাসন ও পুলিশ সিদ্ধান্ত নিয়ে গুলি ছোড়ে। রাস্তা ফাঁকা হলে আমরা চলে আসি। রাতে শুনি একজনের গায়ে গুলি লেগে মারা গেছেন।’

বিজয়ী ইউপি সদস্য জোবায়দুর রহমান বলেন, ‘ফলাফল ঘোষণা দেওয়ার পর সমর্থকদের নিয়ে বাড়িতে ফিরে আসি। আমার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সমর্থকেরা উত্তেজিত থাকলেও তিনি ফলাফল মেনে নিয়েছিলেন। বাড়ির কাছাকাছি গিয়েছি মাত্র। অমনি গুলির আওয়াজ পাই। পরে শুনলাম আমার চাচার গায়ে গুলি লেগেছে।’

এদিকে আজ সকালে দিনাজপুর জেলা প্রশাসক শাকিল আহমেদ ও পুলিশ সুপার শাহ ইফতেখার আহমেদ ওই এলাকা পরিদর্শন করেন। নিহত ব্যক্তির দাফনের জন্য প্রশাসন থেকে ২৫ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। দিনাজপুরের এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজের মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে দুপুরে মোহাম্মদ আলীর লাশ পরিবারের সদস্যদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। বিকেলে নিজ গ্রামে তাঁকে দাফন করা হয়।
পুলিশ সুপার শাহ ইফতেখার আহমেদ জানান, ওই ঘটনায় গতকাল রোববার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জানে আলমকে প্রধান করে তিন সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আজ সোমবার বিকেল পর্যন্ত এ ঘটনায় থানায় মামলা হয়নি।