সিটি নির্বাচন নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে বরিশালে জাপা নেতার ওপর হামলা

বরিশাল নগরের পোর্টরোড এলাকায় গতকাল রোববার দুপুরে একটি অটোরিকশায় জাপা নেতা মুরতজা আবেদীনের (টুপি পড়া) পিস্তল ধরে রেখেছেন শ্রমিকলীগ নেতা রইজ আহম্মেদ (দাঁড়ি আছে) ও তাঁর এক সহযোগী
ছবি: ভিডিও থেকে সংগৃহীত

জাতীয় পার্টির নেতা ও বরিশাল সিটি করপোরেশনের বিদায়ী কাউন্সিলর এ কে এম মুরতজা আবেদীনের ওপর গতকাল রোববারের হামলার ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে।

ভিডিওতে দেখা যায়, শ্রমিক লীগ বরিশাল মহানগরের সাধারণ সম্পাদক রইজ আহম্মেদের সঙ্গে মুরতজার প্রথমে কথা-কাটাকাটি হয়, এরপর ধস্তাধস্তি হয়। গত সিটি করপোরেশন নির্বাচনের জেরে এ ঘটনা ঘটেছে বলে ধারণা করছেন স্থানীয় লোকজন।

মুরতজা আবেদীন জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান ও বরিশাল জেলা কমিটির আহ্বায়ক। তিনি বলেন, এ ঘটনায় তিনি থানায় অভিযোগ দিলেও তা মামলা হিসেবে গ্রহণ করা হয়নি। হামলা হওয়ার প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলন করেছে জাতীয় পার্টি। আজ সোমবার দুপুর ১২টায় বরিশাল প্রেসক্লাবে এই আয়োজন করে জেলা ও মহানগর জাতীয় পার্টি।

এদিকে শ্রমিক লীগ নেতা রইজ আহম্মেদের পক্ষে পাল্টা সংবাদ সম্মেলন করেছেন সংগঠনের নেতারা। তবে ওই সংবাদ সম্মেলনে রইজ আহম্মেদ উপস্থিত ছিলেন না। সোমবার বিকেলে বরিশাল প্রেসক্লাবে এ সংবাদ সম্মেলন হয়।

কী নিয়ে দ্বন্দ্ব?

মুরতজা আবেদীনের ঘনিষ্ঠজনেরা বলেন, মুরতজা ২ নম্বর ওয়ার্ড থেকে পাঁচবার কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। গত নির্বাচনে ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মুরতজা আবেদীনের সঙ্গে দ্বন্দ্ব শুরু হয় রইজ আহম্মেদের। রইজ আহম্মেদ প্রার্থী হলেও প্রার্থিতা বাতিল করে নির্বাচন কমিশন। পরে রইজের ছোট ভাই মুন্না হাওলাদার প্রার্থী হয়ে কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর মুরতজা বাসার বাইরে খুব একটা বের হতেন না। তাঁর পুরো পরিবার আতঙ্কে ছিল।

স্থানীয় নেতা-কর্মীরা বলেন, রইজ আহম্মেদ বরিশাল সিটি করপোরেশন বিদায়ী মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর অনুসারী হিসেবে পরিচিত। গত নির্বাচন চলাকালে বরিশাল সিটির নবনির্বাচিত মেয়র আবুল খায়ের আবদুল্লাহর সমর্থকদের ওপর হামলার অভিযোগে তিনি গ্রেপ্তার হন। গ্রেপ্তার হওয়ার পর মহানগর ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। সম্প্রতি রইজ আহম্মেদকে বরিশাল মহানগর শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে।  

বরিশাল মহানগর শ্রমিক লীগের সংবাদ সম্মলেনে নেতারা বক্তব্য দিচ্ছেন। সোমবার বিকেলে বরিশাল প্রেসক্লাবে
ছবি: প্রথম আলো

কী আছে ভিডিওতে?

রোববারের দুপুরের ওই হামলার ঘটনার দুটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এর একটি ৫৬ সেকেন্ডের, অপরটি ৮ মিনিট ৪৭ সেকেন্ডের। বড় ভিডিওটি বরিশাল নগরের ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর এ কে এম মুরতজা আবেদীনের নিজের মুঠোফোন থেকেই ধারণ করা। রোববার নগরীর পোর্ট রোড সেটেলমেন্ট কার্যালয়ের সামনে এ ঘটনা ঘটে।

ভিডিওতে দেখা যায়, মুরতজা কার্যালয় থেকে বের হওয়ার সময় দেখেন তার বাঁ পাশে বরিশাল রইজ আহম্মেদ ও তাঁর সহযোগীরা দাঁড়িয়ে আছেন। মুরতজা ভূমি অফিসের সামনের সড়কে গিয়ে অটোরিকশা ঠিক করার সময় রইজ ও তাঁর লোকজন পেছন থেকে তাঁর কাছে আসেন।

এ সময় রইজকে উদ্দেশ করে মুরতজা জিজ্ঞেস করেন, ‘ভালো আছ?’ রইজ তখন বলেন, ‘কেডা?’ তখন মুরতজা বলেন, তোরে জিগাই, তোরে।’

এরপর রইজ কিছু একটা বলতে থাকেন। মুরতজা এ সময় বেশ কয়েকবার ঠিক আছে, ঠিক আছে বলে নদীবন্দরের দিকে এগিয়ে গিয়ে অটোরিকশা ঠিক করতে থাকেন। কিছুক্ষণ পর রইজ পেছন থেকে গিয়ে মুরতজাকে বলেন, ‘বেয়াদবি করলি ক্যা?’ মুরতজা বলেন, ‘কী বেয়াদবি করছি?’

এরপর তাঁদের মধ্যে বাগ্‌বিতণ্ডা শুরু হয়। একপর্যায়ে রইজ তেড়ে যান মুরতজার দিকে। তখন মুরতজা চিৎকার শুরু করেন। এ সময় রইজও বলতে থাকেন, ‘আমাকে মারার জন্য পিস্তল বাইর করছে, ধর ধর, ভিডিও কর, ভিডিও কর।’

এ সময় ধস্তাধস্তি শুরু হয়। মুরতজা হাতে পিস্তল হাতে নেন। পরে ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা এসে সেটি নিয়ে নেন। কিন্তু রইজ ও তাঁর অপর এক সহযোগী একটি অটোরিকশায় কাউন্সিলর মুরতজাকে নিয়ে ধরে রাখেন। দুজনের মধ্যে আবার তর্ক শুরু হয়। মুরতজা বলেন, ‘আমাকে মারতেছে।’ রইজ তখন গালি দিয়ে বলেন, ‘তুই আমারে মারতে চাইছ, আমি তোরে ধরছি।’ এ সময় আবার তাঁদের মধ্যে ধস্তাধস্তি হতে দেখা যায়।

হামলার বিষয়ে মুরতজা আবেদীন সোমবার দুপুরে বলেন, ‘সেটেলমেন্ট অফিসের জানালা থেকে ওদের (রইজ) বাইরে আনাগোনা দেখে হামলা হ‌তে পা‌রে এই সন্দেহ করেছিলাম। এরপর আমি ব্যক্তিগত মুঠোফোনের ভিডিও অন করে রেখেছিলাম। আমি যা আশঙ্কা করেছিলাম, তা–ই হয়েছে। বাইরে আসলে রইজ ও তাঁর অনুসারীরা পরিকল্পিতভাবে আমার ওপর হামলা করার পাশাপাশি লাইসেন্স করা পিস্তলটি ছিনিয়ে নিতে চেয়েছিলেন। আমার নিজের করা ভিডিওতে সত্য প্রকাশ পাবে।’

তিনি আরও বলেন, এ ঘটনায় তিনি থানায় মামলার জন্য অভিযোগ জমা দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর আবেদনটি মামলা হিসেবে গ্রহণ করা হয়নি।

রইজ আহম্মেদ গত রোববার বিকেলে বলেছিলেন, পারিবারিক জমিজমার কাজে ভূমি অফিসে যান। সেখানে মুরতজা আবেদীনের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। এরপর তাঁদের দুজনের মধ্যে উচ্চবাচ্য হয়। একপর্যায়ে মুরতজা তাঁকে গুলি করার জন্য পিস্তল বের করেন। সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মুরতজার বিপক্ষে কাউন্সিলর প্রার্থী হওয়ায় তাঁর ওপর এ হামলার ঘটনা ঘটেছে বলে দাবি করেন রইজ।

বরিশালে জাতীয় পার্টি নেতা ও বিদায়ী সিটি কাউন্সিলর মুরতজা আবেদীনের ওপর হামলার ঘটনায় বিচার চেয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন দলটির নেতারা। সোমবার দুপুরে বরিশাল প্রেসক্লাব মিলনায়তনে
ছবি: প্রথম আলো

জাপার সংবাদ সম্মেলন

মুরতজা আবেদীনের ওপর পূর্বপরিকল্পিত হামলার পর রইজ আহম্মেদ মিথ্যা, বানোয়াট তথ্য দিয়ে প্রশাসনসহ বরিশাল নগরবাসীকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা চালাচ্ছেন। তাঁরা রইজ আহম্মেদ ও ঘটনায় জড়িত তাঁর সহযোগীদের চিহ্নিত করে অবিলম্বে গ্রেপ্তারের দাবি জানান। এ ঘটনায় জড়িতরা এখনো বুক ফুলিয়ে শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এতে মুরতজা ও তাঁর পরিবার নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে আছে। মুরতজা মামলার অভিযোগ জমা দিয়েছেন। কিন্তু গতকাল থানা-পুলিশ মামলা রেকর্ড করেনি।
সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় পার্টির জেলা সদস্যসচিব এম এ জলিল, মহানগর কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক বশির আহমেদসহ জেলা ও মহানগর জাতীয় পার্টির সাবেক ও বর্তমান নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

‘হামলার ঘটনাটি নাটক’–দাবি শ্রমিক লীগের

লিখিত বক্তব্যে মহানগর শ্রমিক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বেল্লাল হোসেন বলেন, মুরতজার ওপর হামলার ঘটনাটি সাজানো নাটক। মূলত গত সিটি নির্বাচনে শ্রমিক লীগ নেতা রইজের ভাইয়ের কাছে পরাজিত হওয়ার পর প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে রইজকে হত্যার উদ্দেশ্যে তিনি হামলা চালান। পরে লোকজন তাঁকে ধরে থানায় সোপর্দ করার পর এখন তাঁর ওপর হামলার নাটক সাজিয়েছেন মুরতজা আবেদীন।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও প্যানেল মেয়র গাজী নঈমুল হোসেন বলেন, মুরতজার সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি তাঁর পূর্বপরিকল্পিত। যা ওই ৮ মিনিটের ভিডিও দেখে বোঝা যায়। তিনি বারবার রইজকে উত্তেজিত করছিলেন। এখানে বয়স আর অভিজ্ঞতার বিষয় রয়েছে। যেটিকে ব্যবহার করেছেন মুরতজা আবেদীন।

সাংবাদিকদের অপর এক প্রশ্নের জবাবে গাজী নঈমুল হোসেন বলেন, এ ঘটনা জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের দলীয় রাজনীতির কোনো বিষয় নয়। এটি নিছক ব্যক্তিগত বিষয়। এ নিয়ে আগামী জাতীয় নির্বাচনে জাতীয় পার্টির সঙ্গে আওয়ামী লীগের জোটগত সম্পর্কের কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। তবে এ ঘটনায় তাঁরাও মামলার প্রস্তুতি নিয়েছেন।

সংবাদ সম্মেলনে বরিশাল সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র-১ রফিকুল ইসলাম, মহানগর শ্রমিক লীগের সভাপতি পরিমল চন্দ্র দাসসহ মহানগর আওয়ামী লীগ ও শ্রমিক লীগের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

জানতে চাইলে বরিশাল মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. সাইফুল ইসলাম সোমবার দুপুরে বলেন, মুরতজার লাইসেন্স করা পিস্তলটি ঘটনাস্থলে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল। সেটি পুলিশের কাছেই রয়েছে। আর এ ঘটনায় মুরতজা আবেদীনের পক্ষ থেকে কোনো মামলার আবেদন পাওয়া যায়নি। তবে রইজ একটি আবেদন করেছেন। বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে। মুরতজা আবেদীন মামলা করলে অবশ্যই তা গ্রহণ করা হবে।