সিলেটে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলেই ভেতরে দ্বন্দ্ব, বাইরে ঐক্য

আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ভেতরে চলছে সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি। দুই দলের অন্তত ৩৯ জন নেতা সংসদীয় এলাকায় তৎপর।

সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে আওয়ামী লীগে যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছিল, তা এখনো মেটেনি। বরং সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নেতাদের ‘মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব’ বেড়েই চলেছে। সিলেট বিএনপির রাজনীতিতে ব্যক্তিকেন্দ্রিক প্রভাব কমলেও ভেতরের দ্বন্দ্ব-বিভক্তি রয়েই গেছে। এর মধ্যেই দুই দলেই চলছে আগামী সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি।

গত ২১ জুন অনুষ্ঠিত সিটি নির্বাচনে স্থানীয় নেতাদের টপকে দলীয় মনোনয়নে মেয়র নির্বাচিত হন যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। এ নিয়ে মনোনয়নপ্রত্যাশীরা ভেতরে-ভেতরে ক্ষুব্ধ হন। সর্বশেষ ২ সেপ্টেম্বর ঘোষিত জেলা ও মহানগর যুবলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে আনোয়ারুজ্জামানের অনেক অনুসারীর স্থান পাওয়ার বিষয়টি দুই পক্ষের প্রভাবের রাজনীতির অংশ হিসেবেই দেখা হচ্ছে। জেলার ছয়টি সংসদীয় আসনে একাধিক নেতা মনোনয়ন পেতে তৎপরতা শুরু করায় তৃণমূলে বিভক্তি বাড়ছে বলে মনে করছেন কর্মীরা।

সিলেটে বিএনপির সাম্প্রতিক কর্মসূচিগুলোতে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নেতা-কর্মীর অংশগ্রহণ দেখা যাচ্ছে। এটি দলের ‘ঐক্যের’ ফল বলেই প্রচার করছেন নেতারা। তবে দলের ভেতরের দ্বন্দ্ব এখনো চলমান বলে মনে করছেন অনেকেই। সম্মেলনের ছয় মাসেও মহানগর বিএনপির পূর্ণাঙ্গ কমিটি না হওয়ায় পদপ্রত্যাশীদের হতাশা বাড়ছে।

অনেকে প্রার্থী হতে ইচ্ছুক। তবে দল যাঁকে প্রার্থী করবে, তাঁর পক্ষেই সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকবে। মনোনয়ন চাওয়া নিয়ে অন্তর্দ্বন্দ্ব কিংবা দূরত্ব নেই।
শফিকুর রহমান চৌধুরী, সভাপতি, জেলা আওয়ামী লীগ

প্রভাব বাড়ছে আনোয়ারুজ্জামানের

মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর একটা প্রভাব তৈরি হয়েছে। বিপরীতে স্থানীয় আওয়ামী লীগের একটি অংশ এককাট্টা। প্রকাশ্যে সরব না থাকলেও তাঁরা ‘মেয়রবিরোধী অংশ’ হিসেবেই আলোচিত হচ্ছেন। এর নেতৃত্বে আছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. নাসির উদ্দিন খান এবং মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. জাকির হোসেন।

জেলা আওয়ামী লীগের দুজন নেতা বলেন, মেয়র হওয়ায় ভবিষ্যতে মহানগরের রাজনীতিতে আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। সম্প্রতি মহানগরের পাশাপাশি জেলা ছাত্রলীগ ও যুবলীগও তাদের কর্মসূচিতে আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকদের পাশ কাটিয়ে তাঁকে অতিথি করেছে। ‘মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব’ বাড়ার এটাও অন্যতম কারণ।

মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মাসুক উদ্দিন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, সামনেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তাই দলের নেতা-কর্মীরা সে প্রস্তুতিই এখন ভেতরে-ভেতরে নিচ্ছেন।

গত ১৮ জুলাই নগরের রেজিস্টারি মাঠে জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের ‘শান্তি ও উন্নয়ন শোভাযাত্রার’ আগে আয়োজিত সংক্ষিপ্ত সমাবেশে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ের ঘটনা ঘটে সিলেট-৩ আসনের সংসদ সদস্য হাবিবুর রহমান ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. জাকির হোসেনের মধ্যে। আনোয়ারুজ্জামান ও হাবিবুর একই ঘরানার নেতা হিসেবে পরিচিত।

মহানগরের দুজন নেতা জানিয়েছেন, জাকির হোসেনের সঙ্গে অসদাচরণের বিষয়টি নিয়ে মহানগরের কার্যকরী কমিটির সভায় নিন্দা প্রস্তাব এনে রেজল্যুশন করা হয়েছে। তবে নিন্দা প্রস্তাব আনার বিষয়টি সঠিক নয় বলে দাবি করেছেন হাবিবুর রহমান।

নাসির উদ্দিন খান বলেন, ‘প্রবাসী নেতা হাবিবুর রহমান দলীয় মনোনয়ন পান, তাঁকে পাস করিয়েছি। গত সিটি নির্বাচনে প্রবাসী নেতা আনোয়ারুজ্জামান মনোনয়ন পেয়েছেন, ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে তাঁকেও পাস করিয়েছি। তাঁরা সুন্দরভাবে চলবেন, এটাই আমরা চাই। অথচ আমরা তেমনটা যথাযথভাবে পাচ্ছি না। তাই একটু বিব্রত অবস্থায় আছি।’

মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ‘দলে কোনো বিভেদ বা দ্বন্দ্বও নেই। জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় সব নেতার সঙ্গে আমার সুসম্পর্ক রয়েছে। তাঁদের পাশাপাশি তৃণমূল আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের সমর্থন ছাড়া আমি কখনোই মেয়র পদে জয় পেতাম না, এটা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি।’

আরও পড়ুন

বর্তমানে জেলার ছয় সংসদ সদস্যের মধ্যে পাঁচজনই আওয়ামী লীগের, একজন গণফোরামের। এবার ছয়টি আসনে আওয়ামী লীগের অন্তত ২৩ জন প্রকাশ্যে তৎপর। তাঁদের সমর্থনে কর্মী-সমর্থকেরা বিভক্ত। নেতার দলীয় মনোনয়ন দাবি করে ব্যানার, ফেস্টুন সাঁটাচ্ছেন। নির্বাচনের সময় যত ঘনিয়ে আসবে, অন্তর্দ্বন্দ্ব ততটাই প্রকাশ্য হয়ে উঠতে পারে।

জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শফিকুর রহমান চৌধুরী বলেন, অনেকে প্রার্থী হতে ইচ্ছুক। তবে দল যাঁকে প্রার্থী করবে, তাঁর পক্ষেই সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকবে। মনোনয়ন চাওয়া নিয়ে অন্তর্দ্বন্দ্ব কিংবা দূরত্ব নেই।

এখানে সবাই ঐক্যবদ্ধ। আওয়ামী লীগ সরকারের পতন নিশ্চিতের জন্য সবাই আন্দোলন-সংগ্রাম করছেন।
আবদুল মুক্তাদির, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা

বিএনপিতেও দুই পক্ষের নীরব কোন্দল

সিলেটে বিএনপির রাজনীতি একসময় সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান ও দলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এম ইলিয়াস আলীর পক্ষে বিভক্ত ছিল। এখন দলের একটি বড় অংশে প্রভাব রয়েছে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা খন্দকার আবদুল মুক্তাদিরের। আরেকটি অংশের নেতৃত্বে আছেন সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। তিনিও গতকাল দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টার পদ পেয়েছেন। জেলা বিএনপির সভাপতি আবদুল কাইয়ুম চৌধুরী কোনো বলয়ে না থাকলেও আধিপত্য ও গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে বলে জানিয়েছেন কর্মীরা।

আবদুল মুক্তাদির প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখানে সবাই ঐক্যবদ্ধ। আওয়ামী লীগ সরকারের পতন নিশ্চিতের জন্য সবাই আন্দোলন-সংগ্রাম করছেন।’ একই মন্তব্য করেছেন আরিফুল হক চৌধুরীও। তিনি বলেন, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বাইরে কোনো পক্ষ নেই।

একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিএনপি এখন সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করছে। বিএনপির সিলেট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক শাখাওয়াত হোসেন মনে করেন, সিলেটে দল সাংগঠনিকভাবে যথেষ্ট শক্তিশালী। 

সিলেট মহানগর বিএনপির দ্বিবার্ষিক সম্মেলন চলতি বছরের ১০ মার্চ হয়েছিল। সেখানে ভোটের মাধ্যমে সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচন করা হয়। প্রায় ছয় মাস হতে চললেও এখন পর্যন্ত কমিটি পূর্ণাঙ্গ হয়নি। এতে পদপ্রত্যাশী নেতা-কর্মীদের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে। এক বছর আগে সম্মেলন হওয়া জেলা ও মহানগর যুবদলেরও কমিটি পূর্ণাঙ্গ হয়নি।

মহানগরের একাধিক নেতা বলছেন, মূলত এখন তিন নেতার ওপর নির্ভর করে দলীয় কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। পূর্ণাঙ্গ কমিটি হলে একদিকে নতুন নেতৃত্ব তৈরি হবে, অন্যদিকে সরকারবিরোধী আন্দোলন আরও বেগবান হবে। মহানগর বিএনপির সভাপতি নাসিম হোসাইন বলেন, কেন্দ্রে এরই মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটির নামের তালিকা জমা হয়েছে। দলীয় কর্মসূচি পালনের পাশাপাশি নগরের বর্ধিত ১৫টি ওয়ার্ডেও কমিটি গঠনপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।