সব হারিয়ে নিঃস্ব কলাপাড়ার দুই চরের বাসিন্দারা

ঝড়ের রাতে মুসা–তানিয়া দম্পত্তি সাইক্লোন সেন্টারে তাঁদের সন্তানদের নিয়ে অবস্থান নেয়। পরে সাইক্লোন সেন্টার থেকে ফিরে এসে দেখেন তাঁদের বসতবাড়িটি বিধ্বস্ত অবস্থায় পড়ে আছে। কলাপাড়া উপজেলার কাউয়ারচরেছবি: সাইয়ান

কারও ঘর নেই, কারও রান্না করার চুলা নেই। এক বেলা খাবে, সে পরিস্থিতিও নেই অনেকের। আবার কারও জাল-নৌকা জোয়ারের পানিতে ভেসে গেছে। প্রায় পরিবারেরই হাঁস-মুরগি মারা গেছে। ভেঙে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে মেঠো পথ। এর ফলে মানুষের স্বাভাবিকভাবে চলাচলেও বাধা তৈরি হয়েছে। জোয়ারের পানি না নামায় এখনো থইথই করছে পুরো গ্রাম। ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডবে পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার সাগরপাড়ের জনপদ কাউয়ার চর ও চর গঙ্গামতি এলাকা এভাবে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে।

উপজেলার ধুলাসার ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত কাউয়ার চর ও চর গঙ্গামতি গ্রামের মানুষের বেশির ভাগই জেলে। আবার কেউ কেউ দিনমজুরি করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। কেউ জীবিকা নির্বাহের জন্য হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল পালন করেন। কারও রয়েছে মাছ চাষের পুকুর ও ঘের। গ্রাম দুটির বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঘূর্ণিঝড় রিমাল তাঁদের আয়ের সব পথ একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে গেছে।

আরও পড়ুন

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, রিমালের তাণ্ডবে উপজেলার প্রত্যন্ত জনপদের গ্রাম কাউয়ার চর ও চর গঙ্গামতির বাসিন্দাদের ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়েছে। এত ক্ষতি হওয়ার কারণ কী, এমন প্রশ্নের জবাবে স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের বাইরে গ্রাম দুটির অবস্থান হওয়ায় ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী বঙ্গোপসাগরের জোয়ারের কারণে এমন ক্ষতি হয়েছে।

মঙ্গলবার সরেজমিনে দেখা গেছে, দুটি চরের কিছু ঘর, স্থাপনা বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে আছে। আবার কিছু ঘরের চাল উড়ে গেছে। পুকুর-মাছের ঘের জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় বের হয়ে গেছে চাষের মাছ। চরের বাসিন্দারা বিশুদ্ধ খাবার পানি নিয়ে বড় সংকটে পড়েছেন। চর দুটির অনেক টিউবওয়েলই জোয়ারের পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে।

আরও পড়ুন

কাউয়ার চর এলাকার ইউপি সদস্য রফিকুল ইসলাম তালুকদার জানান, কাউয়ার চর এলাকার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের বাইরের পাশে গভীর নলকূপ ছিল ২৭টি। অগভীর নলকূপ ছিল ৩৫০টি। এসবের মধ্যে তিনটি গভীর নলকূপ ও ১৪৫টি অগভীর নলকূপ জোয়ারের পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে। চর গঙ্গামতি এলাকার ইউপি সদস্য মো. সিদ্দিক হাওলাদার জানান, চর গঙ্গামতি এলাকার বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধের বাইরের দিকে গভীর নলকূপ ছিল ১৮টি। শ্যালো টিউবওয়েল ছিল ৪০০টি। এর মধ্যে ১৭টি গভীর নলকূপ এবং ৪০০টি শ্যালো টিউবওয়েল জোয়ারের পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে।

ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে জলোচ্ছ্বাসের পানিতে বসতবাড়ির চারপাশ তলিয়ে আছে। কলাপাড়া উপজেলার ইউসুফপুরে
ছবি: প্রথম আলো

রাবেয়া বেগম নামের একজন বলেন, ‘ঝড়ের পর আমরা বাড়িঘরে ফিরছি ঠিকই, তয় বড় ভোগান্তিতে আমরা আছি। এমনিতেই আমাগো ঘর-দুয়ার সব শ্যাষ হইয়া গ্যাছে, কোনো কিছুই রক্ষা করতে পারি নাই। অ্যাহন আমরা খাওয়ার পানি লইয়া সবচাইতে বেশি বিপদে পড়ছি। এর কারণ হইলো, আমাগো এই গ্রামের অনেক টিউবয়েলই নষ্ট হইয়া গ্যাছে। আমরা খাদ্যসংকটেও আছি, বিশুদ্ধ খাওয়ার পানির সংকটেও আছি। আমরা খাবারও চাই, বিশুদ্ধ পানিও চাই।’

শুধু খাওয়ার পানির সংকটই নয়। ঘূর্ণিঝড়ে দুটি চরের বাসিন্দাদের হাঁস-মুরগি, ছাগল, গবাদিপশু মারা পড়েছে। নষ্ট হয়েছে বসতঘরের মালামাল। কাউয়ার চরের বাসিন্দা আফজাল হোসেন বলেন, ‘ঝড়ের খবর হুইন্যা আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়া উঠছি। আর কোনো দিকে খেয়াল করতে পারি নাই। জোয়ারের পানিতে আমার ঘরের মালপত্র ভাইস্যা গ্যাছে। দুইডা ছাগল পালতাম। হেই দুইডাও জোয়ারের পানিতে পইড়্যা মরছে।’

ঝড়ের পরে চরের বাসিন্দাদের অনেকেই সর্দি-কাশি ও জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে। তবে এর মধ্যে শিশুর সংখ্যাই বেশি। ইব্রাহিম হাওলাদার নামে একজন জানান, তাঁর চার বছরের শিশু তাওহীদ ও পাঁচ মাস বয়সের শিশু তানভির দুই দিন ধরে জ্বরে ভুগছে। আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার সময় জোয়ারের পানিতে ভিজে তাঁর দুই শিশুপুত্রের ঠান্ডা লেগেছে। এ রকম আরও অনেক শিশু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে।

কাউয়ার চরের একেবারে পূর্ব পাশে লাল কাঁকড়ার চর নামের জায়গাটি জেলেপল্লি হিসেবে পরিচিত। এখানকার একটা উঁচু জায়গায় দেখা গেল ক্ষতিগ্রস্ত একটি পরিবার দুপুরের রান্না করছে। রান্নার কাজে ব্যস্ত থাকা ফাতেমা বেগম নামের এক নারী বলেন, ‘আমাগো ঘরের মধ্যে এখনো জোয়ারের পানি আছে। রান্না করার কোনো পরিস্থিতি নেই। ঘর থুইয়া এই জায়গায় আইয়া রান্না করছি।’ কী রান্না করছেন জানতে চাইলে ফাতেমা বলেন, ‘আতপ চালের ভাত, আর ছোলা বুট। এইয়ার লগে কাঁচা মরিচ দিয়া ভর্তা বানামু। দুফারে এইয়ায় আমরা খামু।’

কাউয়ার চর এলাকার ৮০০ পরিবারের বসবাস। সব মিলিয়ে লোকসংখ্যা প্রায় ২ হাজার ৫০০ জন। এ চরের বাসিন্দাদের অন্যতম একটি সমস্যা হলো, চরে কোনো আশ্রয়কেন্দ্র নেই। ইয়াজুল হক নামে একজন বলেন, ‘আসলে আমাদের ক্ষয়ক্ষতি যা হইছে, তা আর আমরা ফির‌্যা পামু না। ঝড়ের সময় আমাগো দুই থেকে আড়াই কিলোমিটার দূরের আশ্রয়কেন্দ্রে যাইয়া উঠতে হয়। চরের মধ্যে একটা আশ্রয়কেন্দ্র থাকলে আমাগো ভোগান্তি হইত না। আমরা চরেই একটা আশ্রয়কেন্দ্র চাই। এইডা হইলে ঝড়ের সময় আমরা দ্রুত যাইয়া আশ্রয় লইতে পারমু। গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগিও হেইহানে রাখতে পারমু। আমনেরা ওপরের দিকে একটা আশ্রয়কেন্দ্রের কথা জানাইয়েন।’

চর গঙ্গামতি এলাকার বাসিন্দা মোশারফ ফকির বলেন, ‘চর গঙ্গামতি এলাকায় ৩ হাজার মানুষের বসবাস। এই এলাকায় মাত্র একটি আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে। ঝড়ের সময় মানুষজনের একটি আশ্রয়কেন্দ্রে স্থান সংকুলান হয় না। এ চরের মধ্যবর্তী স্থানে আরও একটি আশ্রয়কেন্দ্র দরকার। আরেকটা আশ্রয়কেন্দ্র হইলে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি অনেক কম হইবে।’

রফিক বিশ্বাস, মো. জসিম উদ্দিন, ইসমাইল হাওলাদার, নাসির হাওলাদার, কামাল পাহলানসহ একাধিক জেলে জানান, তাঁদের কারও পাঁচ হাজার হাত, কারও তিন হাজার হাত, কারও সাত হাজার হাত মাছ ধরার জাল জোয়ারের পানিতে ভেসে গেছে। ইলিশ, পোয়া, কোরাল মাছ ধরার কাজে যুক্ত জেলেরা জাল-নৌকা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। কাউয়ার চরের পূর্ব দিকের লাল কাঁকড়ার চর এবং চর গঙ্গামতির ধোলাই মার্কেট এলাকায় সরগরম থাকা জেলেপল্লিতে এখন নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে।

কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. রবিউল ইসলামের কাছে দুটি চরের বাসিন্দাদের এমন দুরবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রথম আলোকে জানান, ঝড়ে ওই দুটি চরের মানুষজনের ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি তিনি শুনেছেন। ইতিমধ্যে খোঁজখবরও নিয়েছেন।

ইউএনও বলেন, ‘কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে তা জানতে চেয়েছি। অবশ্যই দুর্গত মানুষদের জন্য খাদ্যসহ প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যাঁরা ঘরবাড়ি হারিয়েছেন, যাঁরা জাল-নৌকা হারিয়েছেন, তাঁদেরকেও সহায়তা করা হবে। ওই দুটি চরের বাসিন্দাদের ক্ষতিগ্রস্ত অবকাঠামো নির্মাণসহ সব ধরনের সহায়তায় উপজেলা প্রশাসন সাধ্যমতো চেষ্টা করবে।’